আমি জানতে চাই। সিমুলেটেড এমিশানের মতো মজার কোনো ব্যাপার নেই। সবগুলো পরমাণু যখন একসাথে
ট্রিনি বাধা দিয়ে বলল, তোমার জানার দরকার নেই। কেমন করে নিয়ন্ত্রণ সূত্র কাজ করে সেটাও তোমার জানার দরকার নেই।
আমি জানতে চাই। এই গ্রহের মহাকর্ষ বল পৃথিবী থেকে একটু কম, নিয়ন্ত্রণ সূত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন রশ্মিমালা ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু সেটা তোমার জানার দরকার নেই। মেগা কম্পিউটার সেটা জানে।
আমি তবু জানতে চাই।
প্রাচীনকালে মানুষেরা এইসব জানত। ছেলেমেয়েরা স্কুলে শিখত। এখন শিখতে হয়। জ্ঞান এখন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গ্রহণ করতে হয়। অর্থহীন জ্ঞান শিখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
সুহান হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে বল আমার সময় নিয়ে কোনো সমস্যা নেই ট্রিনি। আমার অফুরন্ত সময়। তোমার কাছে যেটা মনে হয় অর্থহীন, আমি সেটাই শিখতে চাই। কোন পরমাণুর শক্তিবলয় কোথায় আমি জানতে চাই। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ কীভাবে কাজ করে আমি জানতে চাই। মহাকর্ষ বল কত শক্তিশালী আমি জানতে চাই। ধাতব জিনিস কেন তাপ পরিবাহী আমি জানতে চাই। নিও পলিমার কেন বিদ্যুৎ পরিবাহী আমি জানতে চাই।
অর্থহীন। ট্রিনি গলা উঁচিয়ে বলল, অর্থহীন!
সুহান একটা চাদর দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে বলল, আমার পুরো জীবনই অর্থহীন।
যদি এখন কোনো মহাকাশযানে করে কোনো মানুষের দল আসে, তুমি তাদের সামনে হবে একজন অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ। তুমি প্রয়োজনীয় একটা জিনিসও জান না।
আমি জানতে চাই না। আর এখানে কোন মানুষ কোনোদিন আসবে না ট্রিনি। তোমার ভয় নেই।
ট্ৰিনি কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক এই সময় একটি মহাকাশযান তার শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে তার গতিবেগ কমিয়ে এই গ্রহটিকে আবর্তন করতে শুরু করেছিল। সেই মহাকাশযানটিতে ছিল প্রায় তিরিশ জন মহাকাশচারী। তাদের সবাই গত পঞ্চাশ বছর থেকে মহাকাশযানের শীতল গ্রহে ঘুমিয়ে আছে। মহাকাশচারীরা তখনো জানত না তাদের এই দীর্ঘ নিদ্রা থেকে কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের জাগিয়ে তোলা হবে। তারা জানত না, যে গ্রহটিতে তারা নামবে সেখানে একজন নিঃসঙ্গ কিশোর তাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে বহুকাল থেকে।
০২. নামহীন গ্রহ
লাইনা চোখ খুলে দেখতে পায় তার মাথার কাছে চতুষ্কোণ স্বচ্ছ একটা নীল আলো। এই আলোটা সে আগেও কোথাও দেখেছে কিন্তু কোথায় দেখেছে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। তার চেতনা এখনো পুরোপুরি সচেতন নয়, সে নিদ্রা এবং জাগরণের মাঝামাঝি এক ধরনের অবস্থায় থেকে আবার ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল। অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে জাগিয়ে তোলে। প্রাণপণ চেষ্টা করে চোখ খোলা রেখে লাইনা মনে করার চেষ্টা করে সে কে, কোথায় শুয়ে আছে এবং কেন তার জেগে ওঠা উচিত। উপরের নীল আলোটা সে আগে কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করতে করতে তার চেতনা আরেকটু সজীব হয়। তখন সে এক ধরনের কম্পন অনুভব করে, কান পেতে সে চাপা একটা গুমগুম শব্দ শুনতে পায়। এই শব্দটিও সে আগে কোথাও শুনেছে কিন্তু এখন কিছুতেই মনে করতে পারে না।
লাইনা চোখ খুলে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে। তার দুই হাত উপাসনার ভঙ্গিতে ভাজ করা। সমস্ত শরীর অর্ধস্বচ্ছ এক ধরনের নিও পলিমার দিয়ে ঢাকা। ডান হাতটা একটু উপরে তুলতেই সে দেখতে পায়, তার কজিতে একটা সেন্সর লাগানো। তখন হঠাৎ করে তার সব মনে পড়ে যায়।
সে লাইনা, একজন মহাকাশচারী মহাবিশ্বে নতুন বসতি খোজার জন্যে সে এবং আরো তিরিশ জন মহাকাশচারী মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল। প্রথম দুই বছর পার হওয়ার পর তারা একে একে সবাই শীতলঘরে ঘুমিয়ে গেছে। কতদিন পার হয়েছে তারপর? সে এখন জেগে উঠেছে কেন? তার অর্থ কি মানুষের বাস করার উপযোগী একটা গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে? এখন কি সেই গ্রহে নামবে তারা?
এক ধরনের উত্তেজনায় লাইনার বুকে হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। ঘুম ভেঙে পরিপূর্ণভাবে জেগে উঠেছে সে। উপরের হালকা নীল আলোটিও তখন চিনতে পারল সে— একটি মনিটর। তার শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশের খুঁটিনাটি তথ্য দেখাচ্ছে সেখানে। তার রক্তচাপ, তার তাপমাত্রা, তার শ্বাসযন্ত্র, পরিপাকতন্ত্রের অবস্থা, তার মস্তিকের কম্পন। উপরে ডান দিকে আজকের তারিখটি জ্বলছে এবং নিভছে। কী আশ্চর্য! এর মাঝে পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে? পঞ্চাশ বছর? অর্ধ শতাব্দী? সে গত অর্ধ শতাব্দী থেকে এই শীতলঘরে ঘুমিয়ে আছে? পৃথিবীতে সে তার যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়পরিজনকে রেখে এসেছে তারা এখন বার্ধক্যে জরাগ্রস্ত? বুকের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে লাইনা। সে আবার নীল স্ক্রিনটার দিকে তাকাল, তার শরীর দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে উঠছে। শীতল গ্রহে সমস্ত জৈবিক প্রক্রিয়া স্তব্ধ করে দেয়া হয়। তাই তার কাছে গত অর্ধ শতাব্দী কয়েক ঘণ্টার বেশি মনে হওয়ার কথা নয়। নীল স্ক্রিনটায় তাই দেখাচ্ছে। সে ইচ্ছে করলে এখন উঠে দাঁড়াতে পারে, উপরের ঢাকনা খুলে বের হতে পারে। কিন্তু তবু সে উপাসনার ভঙ্গিতে দুই হাত বুকের উপরে রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল।
মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুমগুম শব্দটি সে কান পেতে শুনতে থাকে। শব্দটি অনেকটা হৃৎস্পন্দনের মতো। শব্দটি সবাইকে মনে করিয়ে দেয় মহাকাশযানটি বেঁচে আছে, মহাকাশচারীরা বেঁচে আছে, সব কম্পিউটার বেঁচে আছে, মহাকাশযানের ক্রায়োজেনিক ঘরে মানুষের তিন সহস্র ভ্রণ বেঁচে আছে, বৃক্ষ লতাপাতার বীজ, পশুর শুক্রাণু বেঁচে আছে। মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে তারা একটি দায়িত্ব নিয়ে মহাবিশ্বে পাড়ি দিয়েছে। কে জানে হয়তো সেই দীর্ঘ অভিযান এখন সমাপ্ত হয়েছে। লাইনা ফিসফিস করে নিজেকে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে লাইনা, তুমি ওঠ। তোমার এখন নতুন জীবন শুরু হবে।