সুহান ট্রিগার টেনে ধরল তখন।
কিরি অবাক হয়ে দেখে, সুহানের প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র থেকে একটি বিস্ফোরক ঘুরতে ঘুরতে ছুটে আসছে। তার আগে কোনো লেজাররশ্মি নেই, কোনো দৃষ্টিবদ্ধ করার চেষ্টা নেই, কোনো মেগা কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নেই, শুধু একটি সাদামাঠা বিস্ফোরক। কিরির চোখ সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বিস্ফোরকটিকে, তার কপোট্রনের শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্র বিকল করে দিতে চেষ্টা করে বিস্ফোরকটির গতি নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার। কিন্তু সে আবিষ্কার করে কোনো কম্পিউটার নেই বিস্ফোরকটিতে। ঘুরতে ঘুরতে তার দিকে আসছে। একটু উপর দিয়ে কিন্তু এই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সেটাকে টেনে নামিয়ে আনছে নিচে। ঠিক যখন তার কাছে আসবে এটি সোজা আঘাত করবে তার মাথায়। কিরির কপোট্রন জানে সে সরতে পারবে না, তার দেহ মানুষের মতো ধীরস্থির, তার নড়তে সময় প্রয়োজন, সমস্ত শক্তি দিয়েও সে গুলিটি আঘাত করার আগে এক চুল নড়তে পারবে না। প্রাগৈতিহাসিক একটি অস্ত্র থেকে ছুটে আসছে একটি অন্ধ বিস্ফোরক, তাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। কিরি অবাক হয়ে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কিছু করার নেই, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে অপেক্ষা করতে হবে। সেটি প্রায় এক মহাকাল সময়। সেটি প্রায় একটি জীবন।
কিরি বিস্ফোরকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গভীর বিষণ্ণতায় তার বুক হাহাকার করে ওঠে। মানুষ কেন তাকে সৃষ্টি করেছিল মানুষের সব ক্ষুদ্র দিয়ে মানুষ কেন তাকে সৃষ্টি করেছিল দুঃখ কষ্ট আর বেদনা দিয়ে? মানুষ কেন তাকে তৈরি করেছিল মানুষের এত কাছাকাছি…।
মহাকাশযানের জানালা দিয়ে সবাই দেখল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কিরির মস্তিষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উড়ে গেল।
০৪.
খুব ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে আসছে লাইনার। কেউ একজন তাকে ডাকছে কোমল স্বরে। কে? কে ডাকছে তাকে? আবছা কুয়াশার মতো একটা পরদায় সব ঢাকা, কষ্ট করে চোখ খুলে তাকায় সে। তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে অনিন্দ্যসুন্দর একটি মুখ, লম্বা কালো চুল, রাতের আকাশের মতো কালো চোখ। কোথায় দেখেছে সে এই মুখ? কোথায়?
আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিল লাইনা, বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে জোর করে নিজেকে টেনে তুলে আনে লাইনা। চোখ খুলে তাকায় আবার। অপূর্ব সুন্দর একটি মুখ, একটি কিশোরের মুখ, উজ্জ্বল চোখে কিছু একটা বলছে তাকে। কী বলছে সে? কোথায় দেখেছে তাকে? কোথায়?
হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়ে তার। বুকের ভিতর গভীর ভালবাসার একটি স্রোতধারা বাধ ভেঙে ছুটে আসে হঠাৎ। প্রাণপণে চোখ খুলতে চেষ্টা করে লাইনা। তাকে দেখতে হবে সেই মুখটি। সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখটি। তাকে দেখতেই হবে আর একবার।
পরিশিষ্ট
অনেকগুলো শিশু গোল হয়ে বসে আছে একটি আলোকোজ্জল ঘরে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রিনি। তার হাতে একটি স্বচ্ছ কোয়ার্টজের প্রিজম। প্রিজমটি উপরে তুলে সে উচু স্বরে বলল, সবাই চুপ করে বস, কারণ এখন আমাদের বিজ্ঞান শেখার সময়। এটি একটি প্রিজম। প্রিজমের মাঝ দিয়ে আলো গেলে কী হবে?
একটি শিশু মুখ ভেংচে বলল, ছাই হবে।
ছিঃ নিশান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ!
কী হয় বললে?
ট্রিনিকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়। প্রায় দুই যুগ আগে এই শিশুটির পিতাকে কী বলেছিল মনে করতে পারে না। তার কপোট্রনের মেমোরি মডিউলটি দীর্ঘ ব্যবহারে জীর্ণ, পুরোনো তথ্যের ওপর নতুন তথ্য লেখা হয়ে গেছে। ট্ৰিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে একটি উত্তর খুঁজে পাবার কিন্তু কোনো লাভ হয় না। হঠাৎ করে তার ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নড়তে রু করে।
শিশুগুলো উচ্চৈঃস্বরে হাসছে। ট্রিনির আবছাভাবে মনে পড়ে এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছিল। কিন্তু কখন সে মনে করতে পারে না। তার স্মৃতি খুব দুর্বল হয়ে আছে, দীর্ঘ ব্যবহারে তার কপোট্রন জীর্ণ। শুধু মনে পড়ে একটিমাত্র শিশু ছিল তখন, এ রকম অনেকগুলো শিশু নয়।
মানুষের বসতি হয়ে এখন অনেক শিশু হয়েছে এই গ্রহে। শিশুগুলো দুরন্ত, তাদেরকে সামলে রাখা এখন অনেক কঠিন। সুহান আর লাইনাকে বলতে হবে এ রকম করে আর চলতে পারে না। কিছুতেই চলতে পারে না। সুহান আর লাইনা তার কথা না শুনলে অন্যদেরও বলতে হবে। তারা নিশ্চয়ই তার কথা শুনবে। এ রকম করে চলতে পারে না সেটা তাদের স্বীকার করতেই হবে।
কিন্তু ট্ৰিনি জানে এ রকমভাবেই চলবে। কারণ সে মনে হয় এ রকমই চায়। দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের বুকে ভালবাসা থাকার কথা নয়, তার বুকেও নিশ্চয়ই কোনো ভালবাসা নেই। দীর্ঘদিন মানুষের সাথে থেকে এইরকম অযৌক্তিক এবং অর্থহীন কাজ করার বিচিত্র যে প্রবৃত্তির জন্ম নিয়েছে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই অতি ব্যবহারে জীর্ণ একটি কপোট্রনের নানা ধরনের ত্রুটি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ট্রিনি সেভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় না। তার ভাবতে ভালো লাগে সে ভালবাসতে শিখেছে।
মানুষ যেরকম করে ভালবাসে অন্য মানুষকে।