সুহান নিচু গলায় বলল, ডান দিকের বড় পাথরটার পিছনে তাকাও।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ। ঘাপটি মেরে বসে আছে। সাবধান সুহান। লেজারনটি নেবে?
দাও। সুহান হাত বাড়িয়ে ট্রিনির কাছ থেকে লেজারনটি নিল। লেজারন ট্রিনির তৈরি করা একটি কাজ চালানোর মতো যন্ত্র। ট্রিগার ধরতেই একটা হিলিয়াম নিওন লেজাররশ্মি বের হয়, প্রতিফলিত রশ্মি থেকে লেজারনের ছোট মেগা কম্পিউটারটি দূরত্ব ইত্যাদি বের করে নিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে দৃষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। একবার দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে যাবার পর লক্ষ্যবস্তু সরে গেলে বা নড়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই, লেজারনের বিস্ফোরক সেটিকে খুঁজে বের করে তাকে আঘাত করবে। পৃথিবীর অস্ত্রের অনুকরণে তৈরি, সুহানের খুব বেশি বার ব্যবহার করতে হয় নি।
দৃষ্টিবদ্ধ হয়েছে সুহান। এখন গুলি করতে পার।
না, থাক।
কেন? ভিতরে মেগাজুল বিস্ফোরক আছে, লুতুনটি নিঃসন্দেহে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। না, আমি ছিন্নভিন্ন করতে চাই না।
কেন নয়? এই প্রাণীটা তোমার জন্যে ভয়াবহ। এদের সংখ্যা কমাতে পারলে তোমার জন্যে নিরাপদ। তাছাড়া প্রাণীটি তো ধ্বংস হবে না। তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরো থেকে অন্য লুতুনের জন্ম হবে।
কিন্তু একটা লুতুনের বড় হতে কত দিন কেটে যায়! যদি এটা আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে তাহলে গুলি করব। না হয় থাক। আমি হচ্ছি এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। আমি যদি এই গ্রহের অন্য প্রাণীদের দেখেশুনে না রাখি তাহলে কে রাখবে?
ট্রিনি কোনো কথা বলল না। সুহানকে সে তার মতা মায়ের পেট কেটে বের করে একটু একটু করে বড় করেছে। সুহান সম্পর্কে সব তথ্য সে জানে। কিন্তু তবু সে তাকে বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। রবোটের নীতিমালায় তাদেরকে প্রথম যে জিনিসটা শেখানো হয় সেটি হচ্ছে এই ব্যাপারটি। মানুষের চরিত্র, কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে তথ্য সগ্রহ করতে পার, কিন্তু কখনোই তাদের বুঝতে চেষ্টা কোরো না। ট্রিনি তাই সুহানকে বুঝতে চেষ্টা করে না।
০৩.
পৃথিবীর হিসেবে ষোলো বছর আগে যে মহাকাশযানটি এই গ্রহে আশ্রয় নেবার জন্যে নামতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল, সুহান সেখানে থাকে। বিশাল মহাকাশযানের কিছু কিছু অংশ আবার আশ্চর্য রকম অবিকৃত রয়ে গেছে। সেরকম একটা অংশে সুহান থাকে। মহাকাশচারীদের থাকার ঘরগুলোর কয়েকটা রক্ষা পেয়েছে, কোনো কোনোটিতে তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিসপত্র রয়ে গেছে কিন্তু সুহান থাকার জন্যে বেছে নিয়েছে বিশাল ইঞ্জিনঘরটি। অতিশয় ইঞ্জিনটির ভিতরে খানিকটা সমতল জায়গায় সে ঘুমায়। যখন তার ঘুম আসে না সে তখন এই অসম্ভব জটিল ইঞ্জিনটি কীভাবে কাজ করত ভেবে বের করার চেষ্টা করে।
আজকেও শুয়ে শুয়ে সে ইঞ্জিনটার দিকে তাকিয়েছিল। একটা সোনালি রঙের নল উপর থেকে ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে এসে চৌকোণাে বাক্সের মাঝে ঢুকে গেছে। শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে চেষ্টা করে এই সোনালি নলটি কী কাজে ব্যবহার করা হত। ট্ৰিনি ইঞ্জিনঘরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, বাতি নিভিয়ে দেব সুহান?
না।
কেন নয়? তোমার ঘুমানোর সময় হয়েছে। তাছাড়া সৌর ব্যাটারিগুলো আমাদের বাচিয়ে রাখা দরকার। প্রয়োজন না হলে বিদ্যুৎ খরচ করা ঠিক নয়।
বিদ্যুৎ নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়ো না। আমি তোমাকে একটা জেনারেটর তৈরি করে দেব। কিন্তু এখন তুমি কী করছ?
সোনালি রঙের এই নলটি কী কাজে ব্যবহার করা হত বোঝার চেষ্টা করছি।
সুহান, আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি তুমি অর্থহীন কাজে অনেক সময় নষ্ট কর। মানুষের সময়ের খুব অভাব। তাদের অনেক যত্ন করে সময়কে ব্যবহার করার কথা।
আমার সময়ের কোনো অভাব নেই।
কিন্তু তোমার মানুষের মতো ব্যবহার করা শেখা দরকার।
সুহান চোখ নাচিয়ে বলল, আমার যেটা করতে ভালো লাগে আমি সেটাই করব।
কিন্তু সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। তুমি যেটা করছ সেটা নিয়মের বাইরে। বিশ্বজগতের জ্ঞানভাণ্ডার বিশাল। মানুষ কোনোদিন তার পুরোটুকু জানতে পারবে না। তাই তাদের জানতে হয় কোন জ্ঞানটি কোথায় আছে সেই তথ্যটি।
আমি সেটা জানতে চাই না।কোন জ্ঞানটি কোথায় পাওয়া যায় সেটি জেনে আনন্দ কোথায়?
আনন্দের জন্যে জ্ঞান নয়। জ্ঞান হচ্ছে ব্যবহারের জন্যে। মহাকাশযানের এই ইঞ্জিনটি কীভাবে কাজ করে জানা সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ এটা জেনে তুমি কোনোদিন একটা ইঞ্জিন তৈরি করতে পারবে না। ইঞ্জিনটি তৈরি করতে হলে তোমাকে জানতে হবে সেটি কী কী অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেই অংশগুলো কীভাবে জুড়ে দিতে হয়। সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এইসব তথ্য রয়েছে মূল তথ্যকেন্দ্রে। তোমাকে সেটা জানতে হবে। জ্ঞান অর্থ হচ্ছে তথ্যকেন্দ্র সম্পর্কে একটি ধারণা।
সুহান তার বিছানায় উঠে বসে বলল, তুমি বলছ আমার এখন বসে বসে মুখস্থ করার কথা কোন তথ্যকেন্দ্রে কী আছে?
হ্যাঁ। কেমন করে তথ্যকেন্দ্রের তথ্য বের করতে হয়, কেমন করে ব্যবহার করতে হয়। যে মানুষ সেটি যত সহজে ব্যবহার করতে পারে সে তত প্রয়োজনীয়।
ছাই প্রয়োজনীয়!
কোন তথ্যকেন্দ্রে কোন তথ্য আছে জানতে পারলে তুমি ইচ্ছে করলে একটি মহাকাশযান তৈরি করতে পারবে। মহাকাশযানের ইঞ্জিন ঠিক করতে পারবে। তার জন্যে কোন সোনালি রঙের নল দিয়ে কী জ্বালানি যায় সেটি জানার কোনো দরকার নেই।
আমি তবু জানতে চাই।
লেজারন তৈরি হলে তোমাকে জানতে হবে কোন লেজার টিউব, কোন বিস্ফোরক লঞ্চারের সাথে কী রকম মেগা কম্পিউটার জুড়ে দিতে হবে। কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ সূত্র ব্যবহার করতে হবে। তোমার কখনো জানার দরকার নেই কেমন করে নেজার কাজ করে—