প্রথম প্রজাতির মানুষ?
হ্যাঁ।
ও। ট্ৰিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি কেমন করে বোঝাপড়া করবে, সুহান?
আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।
কেন নয়?
কারণ আমি জানি না।
তুমি জান না?
না।
ও ট্ৰিনি আবার চুপ করে গেল।
সুহান আবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে এক ধরনের লালচে আভা। আবার ঝড় আসবে। সে অন্যমনকের মতো কয়েক পা হেঁটে সামনে যায়। তারপর ঘুরে ট্রিনির দিকে তাকাল, বলল, ট্রিনি, আমার সেই অস্ত্রটি কোথায়?
কোন অস্ত্র?
আমি যেটা তৈরি করেছিলাম। একটা নল, তার সাথে একটা ট্রিগার, আর ধরার জন্যে একটা হাতল, যার ভিতরে বিস্ফোরক ভরে আমি গুলি করি?
যেটিতে মেগা কম্পিউটার নেই?
হ্যাঁ।
যেটিতে বন্ধ করার জন্যে কোনো লেজার নেই? যেটি তুমি চোখের আন্দাজে ব্যবহার কর? যেটি আসলে কোনো অস্ত্র নয়, একটি বিপজ্জনক খেলনা?
হ্যাঁ, কোথায় সেটা?
আছে এখানে।
আমাকে এনে দাও।
ট্রিনি খানিকক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে। এনে দিচ্ছি।
ট্ৰিনি প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্ত্রের মতো দেখতে এই অস্ত্রটি সুহানের উরুর সাথে বেঁধে দিল। জিজ্ঞেস করল, ভেতরে বিস্ফোরক আছে ট্রিনি?
আছে।
বুলেট?
আছে।
বুলেট বিস্ফোরক আছে ট্রিনি?
আছে। চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক।
সুহান তখন লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে। ট্রিনি বলল, আমি তোমাকে পৌছে দেব সহান, সাবধানে নিয়ে যাব কিরি যেন টের না পায়।
তার আর কোনো প্রয়োজন নেই, ট্ৰিনি।
ট্ৰিনি নিচু স্বরে বলল, তুমি আমাকে বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে চলে যাচ্ছ সুহান।
সুহান ঘুরে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আমার বিদায় সম্ভাষণ জানাতে ভালো লাগে না, ট্রিনি।
কিরি কন্ট্রোলরুমে বড় স্ক্রিনটার সামনে দাঁড়িয়েছিল। সুহানকে সে বাই ভার্বালে করে উড়ে আসতে দেখল। মহাকাশযানটিকে দুবার ঘুরিয়ে বাই ভার্বালটি সে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে মহাকাশযানের কাছাকাছি থামিয়ে সেখান থেকে নেমে আসে। তারপর সে হেঁটে হেঁটে মহাকাশযানের কাছাকাছি একটা পাথরে হেলান দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভিতরে কোনো উত্তেজনা নেই, ঝড়ো বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার মাঝে সে সম্পূর্ণ অবিচলিত ভঙ্গিতে মহাকাশযানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে সুহানকে প্রথম দেখতে পেল রিশা। বিশাল ধু-ধু শূন্য প্রান্তরে একটি বড় পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অনিন্দ্যসুন্দর কিশোর। এটি যেন কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়, যেন একটি স্বপ্নের দৃশ্য। যেন কাল্পনিক কোনো জগৎ থেকে নেমে এসেছে একটি রক্তমাংসের মানুষ। রিশার চিৎকার শুনে কয়েকজন ছুটে আসে। তাদের দেখাদেখি অন্যেরা। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই মহাকাশযানের জানালা দিয়ে অবাক হয়ে বাইরে তাকিয়ে এই বিচিত্র কিশোরটিকে দেখতে থাকে। যাকে হত্যা করার জন্যে কিরি। মানুষ থেকে অমানুষে পাল্টে গেছে।
কিরি তার স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে রইল দীর্ঘ সময়। ছেলেটি খালি হাতে এসেছে, উরুতে কিছু একটা বাধা আছে, সেটি কোনো এক ধরনের অস্ত্র মনে হতে পারে কিন্তু সে জানে সেটি সত্যিকারের অস্ত্র নয়। বলা যেতে পারে, সে এসেছে আত্মহত্যা করতে। কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ছেলেটিকে তার হত্যা করার কথা ছিল, কিন্তু এভাবে নয়। কিন্তু সে যদি এভাবেই চায় তাহলে এভাবেই হোক। সে প্রতিরক্ষা রবোটটিকে ডেকে বলল, কিউ-৪৬, মহাকাশযানের দরজা খুলে দাও। আমি একটু যাব।
মহাকাশযানের ভারি দরজা ঘরঘর শব্দ করে উঠে যায়। ঝড়ো বাতাস এসে ঝাপ্টা দেয় কিরিকে। সেই বাতাসে হেঁটে হেঁটে সে সুহানের দিকে এগিয়ে গেল। তার কাছাকাছি গিয়ে নরম গলায় বলল, আমি তোমাকে এভাবে আশা করি নি।
সুহান হিসহিস করে বলল, লাইলা কোথায়?
আছে।
কোথায় আছে?
ঘুমিয়ে আছে। শীতলঘরে ঘুমিয়ে আছে।
সুহান হিংস্র স্বরে বলল, শয়তান!
কিরি শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তুমি কেন এখানে এসেছ?
তোমাকে শেষ করতে এসেছি।
তুমি জান আমি দশম প্রজাতির রবোট?
জানি।
তুমি জান আমাকে হত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র তৈরি হয় নি পৃথিবীতে?
সুহান তার উরু থেকে অস্ত্রটি টেনে হাতে নিয়ে কিরির দিকে তাক করে বলল, এই অস্ত্রটি পৃথিবীতে তৈরি হয় নি।
তুমি জান আমার দিকে একটি অস্ত্র তাক করা মাত্র আমার সংবেদনশীল দেহ সেটি জানতে পারে? তুমি জান লেজার রশ্মি দৃষ্টিবদ্ধ করা মাত্র আমার কপোট্রনের হাইপার কিউব অস্ত্রের মেগা কম্পিউটার অচল করে দেয়? তুমি জান গুলি করা মাত্র বিস্ফোরক তার গতিপথ পরিবর্তন করে অস্ত্রধারীর কাছে ফিরে যায়?
এখন জানলাম।
তুমি জান আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু?
মানুষ মানুষকে হত্যা করে কিরি। রবোটকে না। রবোটকে ধ্বংস করে। আমি তোমাকে হত্যা করব না, ধ্বংস করব।
কিরি সুহানের দিকে তাকাল, তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে সূক্ষ্ম অপমানে। সুহান তার প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র তুলে ধরেছে। কিরি আবার তাকাল সুহানের চোখের দিকে। কী সহজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে এই কিশোর! শুধুমাত্র মানুষই বুঝি পারে এ রকম, তার ভিতরে হঠাৎ ঈর্ষার একটি খোচা অনুভব করে সে। সুহানের চোখের দিকে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর তীব্র দৃষ্টি! কী গভীর আত্মপ্রত্যয়! কী আশ্চর্য একাগ্রতা! কিরি তার সমস্ত কপোট্রনকে স্থির করিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে লেজার রশ্মির জন্যে, মেগা কম্পিউটারের সঙ্কেতের জন্যে।