লাইনা ভয়ার্ত মুখে কিরির দিকে তাকাল। একটা অমানুষিক আতঙ্কে তার হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। কিরি একটা হাত বাড়িয়ে লাইনাকে স্পর্শ করে বলল, তুমি জানতে চাইছ না আমি তোমাকে কেমন করে খুঁজে পেয়েছি?
লাইনা কোনো কথা বলল না।
অনেক কষ্ট হয়েছে লাইনা। কাল সারা রাত দুটি উপগ্রহ তোমাদের খুঁজেছে। জেনারেটরগুলো নষ্ট, মহাকাশযানে বিদ্যুৎপ্রবাহ খুব কম, তাই খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তোমাকে পেয়েছি। কিরি সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে তাকে হ্যাচকা টানে ক্যাপসুল থেকে বের করে আনে।
লাইনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কিরি সেটা লক্ষ করল না, অনেকটা নিজের মনে বলল, ছেলেটির জন্যে অপেক্ষা করে লাভ নেই। সে নিজেই আসবে আমার কাছে।
একটু থেমে যোগ করল, আমি যেরকম এসেছি!
কালো একটা ক্যাপসুলে শুয়ে আছে লাইনা, তার দুই হাত উপাসনার ভঙ্গিতে রাখা। তার কপালে এবং হতের কজিতে সেন্সর লাগানো। তার মাথার উপর একটা নীল মনিটর। সেখানে তার তাপমাত্রা, রক্তচাপ, শ্বাসযন্ত্র আর পরিপাকতন্ত্রের অবস্থা, মস্তিষ্কের কম্পন এবং আরো খুঁটিনাটি তথ্য ভেসে আসছে। মাথার কাছে একটি ছোট টিউব দিয়ে মিষ্টি গন্ধের গ্রুস্টান গ্যাস আসছে, তার দেহ অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। প্রথমে শরীর, তারপর মন, সবার শেষে মস্তিষ্ক। তারপর সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাবে।
লাইনা চোখ খুলে তাকাল। তার বুকের ভিতর এক গভীর শূন্যতা। এক গভীর হাহাকার। তার ইচ্ছে করছে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে সারা সৃষ্টিজগৎ ছারখার করে দিতে। কিন্তু সে তার চোখের পাতাও নাড়াতে পারছে না। গভীর ঘুমের জন্যে তার দেহকে প্রস্তুত করছে গ্রস্টান গ্যাস।
ক্যাপসুলের উপর হঠাৎ কিরির মুখ ভেসে আসে। সে মাথা নিচু করে লাইনার কাছাকাছি এসে নরম হাতে তার চুল স্পর্শ করে কোমল গলায় বলল, ঘুমাও লাইনা। ঘুমাও।
লাইনা এক ধরনের অসহায় আতঙ্কে কিরির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরি তার আরো কাছে এসে বলল, তোমাকে কত দিনের জন্যে ঘুম পাড়াব জান? এক শ বছর! যখন তুমি জেগে উঠবে তখন এই গ্রহে আর কেউ থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি।
কিরি বিষণ্ণ স্বরে বলল, মানুষের বসতি এই গ্রহে হবে না লাইনা। হতে পারত কিন্তু হবে না। কেন হবে না জান? কারণ আমি চাই না, তাই হবে না। আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমি যা চাই তাই করতে পারি। আমি মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষ যেরকম অন্যায় করতে পারে, আমিও পারি। মানুষ যেরকম নিষ্ঠুরতা করতে পারে, আমিও পারি। মানুষ যেরকম ভালবাসতে পারে, আমিও পারি!
কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি একটি একটি করে প্রাণ ধ্বংস করব। একটি একটি করে ঐণ। তারপর আমি এই ক্যাপসুলের সামনে থাকব। শুধু তুমি আর আমি। আর মহাকাল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখব, তোমার সুহান এই মহাকাশযানকে ঘিরে ঘুরে বেড়াবে। ধীরে ধীরে তার বয়স হবে, তার চোখের দৃষ্টি ম্লান হয়ে আসবে। তার হৃদযন্ত্র। দুর্বল হবে, ত্বকের মাঝে হবে কুঞ্চিত বলিরেখা। মাথার চুল হবে তুষারের মতো সাদা। তারপর একদিন সে এই মহাকাশযানের বাইরে হাঁটু ভেঙে পড়বে। তার দেহ পড়ে থাকবে দীর্ঘদিন। ঝড়ো বাতাসে একদিন তার দেহ ঢাকা পড়ে যাবে শুকনো বালুর নিচে।
তারপর একদিন আমি তোমাকে ডেকে তুলব। ঘুম ভেঙে উঠবে তুমি, যেন এইমাত্র উঠেছ। তোমার শরীর হবে সতেজ, তোমার মন হবে জীবন্ত। সঙ্গীতের সুর বেজে উঠবে মহাকাশযানে, আর আমার হাত ধরে তুমি হাঁটবে এই করিডোরে। শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি।
কিরির সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে, চোখ থেকে হঠাৎ উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বের হয়ে আসে। শরীর থেকে বিদ্যুৎফুলিঙ্গ বের হয়ে আসে কিলবিল করে।
ভয়াবহ আতঙ্কে লাইনা কিরির দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ঘুম নেমে আসছে, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো ঘুম। সে ঘুমাতে চায় না। তার সমস্ত মনপ্রাণ অস্তিত্ব চিৎকার করতে থাকে কিন্তু তবু তার চোখে ঘুম নেমে আসে। অসহায় মূক এক ধরনের আতঙ্কে ছটফট করতে করতে সে অচেতন হয়ে পড়ে। তার দেহ শীতল হয়ে আসে, ক্যাপসুলের ঢাকনাটা নিচে নেমে আসে ধীরে ধীরে।
কিরি গভীর ভালবাসায় বলল, ঘুমাও লাইনা। সোনামণি আমার।
০৩.
সুহান খোলা সিলিন্ডারটির দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বুকের মাঝে সে এক গভীর শূন্যতা অনুভব করে, এক গভীর হাহাকার। জীবন পূর্ণতার কত কাছাকাছি এসে আবার শূন্য হয়ে গেল! লাইনা—তার লাইনা! কিরি এসে নিয়ে গেছে তার লাইনাকে।
সিলিন্ডারটা ধরে চিৎকার করে ওঠে সে একটা আহত বন্য পর মতো। দুই হাত দিয়ে আঘাত করে সিলিন্ডারের উপর, মাথা কুটে, তারপর মাটিতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে শিশুর মতো।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ সে মুখ তুলে উঠে দাঁড়ায়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে। সে একবার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। ট্ৰিনি এতক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। সুহানকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বলল, তুমি এখন কী করবে সুহান?
সুহান অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিরির সাথে একটা বোঝাপড়া করতে হবে আমার।
কিরি?
হ্যাঁ। কিরি। হয় কিরি বেঁচে থাকবে, না হয় আমি।
কিরি দশম প্রজাতির রবোট, সুহান।
সুহান ট্রিনির দিকে তাকিয়ে তীব্র স্বরে বলল, আমি প্রথম প্রজাতির মানুষ।