লাইনা তখনো ভয়ে একটু একটু কাঁপছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হঠাৎ দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছি।
আপনার ভয় পাওয়ার অনেক কারণ আছে মহামান্যা লাইনা।
কেন, এ রকম বলছ কেন?
সুহান দাবি করছে সে আপনার প্রেমে পড়েছে। এবং সে অনেক বিপজ্জনক কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
লাইনা শব্দ করে হেসে বলল, সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজটি সে ইতিমধ্যে করে এসেছে। ট্রিনি!
সুহান চাপা গলায় বলল, কথা বলার সময় নেই, তাড়াতাড়ি পালাতে হবে।
আমি বাই ভার্বালে শক্তিশালী ব্যাটারি ভরে এনেছি। সুহান, তুমি মহামান্যা লাইনাকে নিয়ে আস।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাই ভার্বালটি মাটি থেকে প্রায় এক-মানুষ উচ্চতা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যেতে থাকল।
সুহান চাপা গলায় বলল, আস্তে ট্রিনি, খারাপ দুর্ঘটনা হতে পারে।
ট্ৰিনি তার কথার কোনো উত্তর দিল না।
০৭. মুখোমুখি
মৃত একটা আগ্নেয়গিরির ভিতর একটি গুহায় লাইনা আর সুহান জড়াজড়ি করে বসেছে। বাইরে ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। কিরির চোখ থেকে বাঁচার জন্যে তারা যে জায়গাটি বেছে নিয়েছে সেটি গ্রহটির প্রায় অন্য পৃষ্ঠে। জায়গাটা হিমশীতল। সুহান আর লাইনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে ট্রিনি। তাকে দেখে মনে হতে পারে ঠিক কী করা প্রয়োজন সে বুঝতে পারছে না।
লাইনা বলল, ট্রিনি, তুমি যদি দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের কাছে বসতে, খুব চমৎকার হত।
ট্ৰিনি ঘুরে জিজ্ঞেস করল, কেন চমৎকার হত?
সবাই বসে থাকলে খুব একটা ঘরোয়া ভাব হয়। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন, যখন বাইরে তুষার ঝড় হত তখন আমরা সবাই ঘরের ভেতর জড়াজড়ি করে বসে থাকতাম। একটা আগুন জ্বলত। সত্যিকারের আগুন। সেই আগুনের সামনে আমরা বসে বসে গল্প করতাম।
বসে গল্প করা এবং দাঁড়িয়ে গল্প করার মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, মহামান্যা লাইনা।
লাইনা তরল গলায় হেসে উঠে বলল, দাঁড়িয়ে মানুষ আবার গল্প করে কেমন করে? গল্প করতে হয় বসে। একটা আগুনকে ঘিরে। গরম কোনো পানীয় খেতে খেতে। খুব একটা ঘরোয়া ভাব হয়। কোমল শান্ত একটা ভাব।
মহামান্যা লাইনা, আগুন খুব বিপজ্জনক জিনিস। সেটাকে ঘিরে বসে থাকলে শান্ত ভাব হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
সুহান গলা উঁচিয়ে বলল, ট্রিনি, তুমি কেন বাজে তর্ক করছ? মানুষের সভ্যতা এসেছে আগুন থেকে।
মানুষের সভ্যতাটি খুব ভালো জিনিস নয়।
লাইনা খিলখিল করে হেসে বলল, একেবারে খাটি কথা বলেছ তুমি ট্রিনি! একেবারে খাটি কথা!
সুহান লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, লাইনা, ট্রিনিকে তুমি বেশি প্রশ্রয় দিও না, একেবারে জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে!
লাইনা ট্রিনিকে বলল, ট্রিনি, তুমি কাছে এসে বস।
সুহান উচ্চৈঃস্বরে হেসে বলল, লাইনা, ট্ৰিনি একটি জোড়াতালি দেয়া রবোট। সে বসতে পারে না! বসার জন্যে হাঁটুর প্রয়োজন হয়। ট্রিনির কোনো হাঁটু নেই।
ট্রেনি বলল, বসার জন্য হাঁটুর প্রয়োজন হয় সেটি পুরোপুরি সত্যি কথা নয়।
ঠিক আছে, পুরোপুরি সত্যি নয় কিন্তু অনেকখানি সত্যি।
ট্রিনি কোনো কথা না বলে গুহা থেকে বের হয়ে গেল। লাইনা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেল ট্রিনি?
জানি না, আসবে এক্ষুনি।
সত্যি সত্যি ট্ৰিনি একটু পরে ফিরে এল, তার হাতে বাই ভার্বালের বাড়তি ছোট ইঞ্জিনটি।
ইঞ্জিন কেন এনেছ ট্রিনি?
এটা চালু করলে আগুন বের হতে থাকে, তখন আমরা সবাই এটাকে ঘিরে বসতে পারি। সুহান যদি আমাকে সাহায্য করে হাঁটু ছাড়াও বসা সম্ভব হতে পারে।
একটু পরে দেখা গেল গুহার মাঝামাঝি বাই ভার্বালের ইঞ্জিন থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। ইঞ্জিনটির খুব কাছাকাছি, প্রায় বিপজ্জনক দূরত্বে বসে আছে একটি বিভ্রান্ত রবোট এবং দুজন আনন্মেত্ত মানব-মানবী। তারা কথা বলছে, হাসছে, একজন আরেকজনকে স্পর্শ করছে এবং সম্পূর্ণ অকারণে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছে।
সেটি ছিল এই গ্রহে মানুষের প্রথম ভালবাসার রাত।
০২.
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে লাইনা আবিষ্কার করল সুহান তার অনেক আগে উঠে গেছে। তার মাথার কাছে একটা ছোট রেকর্ডিং যন্ত্র। সেটা স্পর্শ করতেই সুহানের ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে উঠল, হাত নেড়ে বলছে—আমাদের এখানে দীর্ঘ সময় লুকিয়ে থাকতে হতে পারে। আমি আর ট্রিনি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে গেলাম। দ্বিতীয় সূর্য ওঠার আগে চলে আসব, তুমি ভয় পেয়ো না। এই জায়গাটি নিরাপদ।
লাইনা তার ঘুমানোর ছোট সিলিন্ডারটিতে উঠে বসে। গত রাতে তার ঘুমোতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে তাকে মতিক রেজোনেট করে ঘুমাতে হয়েছে। এভাবে গভীর ঘুম হয় সত্যি কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর দীর্ঘ সময় চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে থাকে। সিলিন্ডারের ভিতরে বাতাসের অনুপাত ঠিক করে রাখা ছিল। বাইরে যাবার আগে তার সম্ভবত অক্সিজেন মাস্কটি পরে নেয়া দরকার।
লাইনা যখন তার মুখে অক্সিজেন মাস্কটি লাগাচ্ছিল তখন হঠাৎ সিলিন্ডারের ওপর একজন মানুষের ছায়া পড়ে। চোখ তুলে তাকানোর আগেই হঠাৎ লাইনা বুঝতে পারে, মানুষটি কিরি। সে ঘুরে তাকাল, সত্যিই সিলিন্ডারের উপর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লাইনাকে দেখে সে সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসল।
লাইনা একটা আর্ত চিৎকার করতে গিয়ে থেমে যায়। এই নির্জন গ্রহে কেউ তার চিৎকার শুনতে পাবে না।
কিরি হাত দিয়ে অনায়াসে সিলিন্ডারের ঢাকনাটি খুলে ফেলে হাসিমুখে বলল, আমি তোমাকে নিতে এসেছি লাইনা।