লাইনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, বহুদূরে একটা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে তার লাল আভায় চারদিকে এক ধরনের বিচিত্র লাল আভা। কী বিচিত্র এই গ্রহটি!
লাইনা হঠাৎ ঘরে একটি পদশব্দ শুনতে পায়। কেউ একজন নিঃশব্দে হাঁটছে তার ঘরে। এই ঘরে নিঃশব্দে হাঁটতে পারে শুধু একজন, সে হচ্ছে কিরি। লাইনার বুক কেঁপে উঠল ভয়ে, চাপা গলায় বলল, কে? কে ওখানে?
আমি। আমি সুহান।
সুহান! লাইনা ছুটে গেল। সাথে সাথে অনুভব করল, একজোড়া শক্ত হাত তাকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে। তার চুলে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলছে, লাইনা, আমার মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।
লাইনা মুখ তুলে অবাক হয়ে এই কিশোরটির দিকে তাকাল। আবছা অন্ধকারে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে ক্ষীণ লাল আলো আসছে, সেই আলোতে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি সে বুঝি এক ভিন্ন গ্রহের মানুষ।
সুহান মাথা নিচু করে লাইনার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল, আমি তোমাকে নিতে এসেছি লাইনা, তুমি যাবে আমার সাথে?
সুহানের চোখে গ্রহটির লাল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। কী বিচিত্র দেখাচ্ছে তাকে। লাইনা অবাক হয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে পুরো জীবনটি তার মনে পড়ে যায়। সবকিছু অর্থহীন মনে হতে থাকে, মনে হতে থাকে, সে বুঝি এই আহ্বানটির জন্যেই সারা জীবন অপেক্ষা করে ছিল। লাইনা সুহানের মাথা নিজের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ সুহান, আমি যাব তোমার সাথে।
সত্যি যাবে?
সত্যি যাব।
চল তাহলে।
কেমন করে?
সুহান মৃদু স্বরে হেসে বলল, সেটা নিয়ে তুমি ভেবো না। এই মহাকাশযানের দূষিত বাতাস বের হওয়ার একটা টানেল আছে। সেই টানেল দিয়ে বের হয়ে যাব। দুটি বড় বড় ফ্যানের পিছনে একটা টারবাইন। ফ্যানগুলো যখন ঘুরতে থাকে কেউ বের হতে পারবে না, কিন্তু এখন সব থেমে আছে।
কতক্ষণ থেমে থাকবে?
অনেকক্ষণ। সুহান নিচু গলায় হেসে বলল, আমি সব ধ্বংস করে দিয়েছি।
কেমন করে ধ্বংস করলে?
বলব তোমাকে। এখন চল। টারবাইনটি হাত দিয়ে ঠেলে ঘুরাতে হবে। অনেক শক্ত হবে কিন্তু দুজনে মিলে যদি ঠেলি নিশ্চয়ই খুলে যাবে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমি ঠিক এ রকম একটা মহাকাশযানে থাকি। আমারটা অবশ্যি ধসে আছে।
বাইরে কিছু মানুষের, কিছু রবোটের পদশব্দ শোনা যায়। একটা ছোট এলার্ম বাজতে থাকে, আলো দুলাতে দুলাতে কে যেন ছুটে যায়। সুহান বলল, আর দেরি করা ঠিক নয়, চল যাই।
চল। কিন্তু কী নিতে হবে?
তোমার কি অক্সিজেন মাস্ক আছে?
আছে।
সেটা নিয়ে নাও। এই গ্রহের বাতাসে আমি নিশ্বাস নিতে পারি কিন্তু তুমি পারবে কি না জানি না।
সুহানের পিছু পিছু গুড়ি মেরে লাইনা একটা অন্ধকার টানেলের ভিতর দিয়ে যেতে থাকে। সুহান না হয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ হলে সে তার সমস্ত ভবিষ্যৎ তার হাতে এভাবে তুলে দিত কি না সে জানে না। কিরির সাথে পাল্লা দিয়ে সে যেভাবে দুই দুইবার নিজেকে রক্ষা করেছে তার কোনো তুলনা নেই। মানুষের সনাতন পদ্ধতিতে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করলে সে কখনোই পারত না। লাইনার হঠাৎ কেমন জানি বিশ্বাস হতে থাকে, এই আশ্চর্য কিশোরটি হয়তো সত্যিই কিরির চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে।
সম্পূর্ণ অন্ধকার একটি টানেলের ভিতর গড়িয়ে গড়িয়ে দুজন এক সময় একটি খোলা জায়গায় পৌছাল। সামনে শক্ত দেয়ালের মতো, লাইনা হাত দিয়ে দেখে তৈলাক্ত কিছু জিনিসে ভেজা। সুহান চাপা গলায় বলল, টারবাইন। ধাক্কা দিয়ে খুলতে হবে।
শক্ত পাথরের মতো অনড়, ধাক্কা দিয়ে খোলার কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সুহানের দেখাদেখি লাইনাও হাত লাগায়। দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, তখন সত্যিই সেই বিশাল টারবাইন নড়ে উঠে একটু একটু করে খুলতে থাকে। সাবধানে একজন মানুষ বের হওয়ার মতো জায়গা করে তারা নিচে তাকাল, বাইরে মুক্ত গ্রহ।
সুহান বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে লাইনাকে বলল, তুমি অক্সিজেন মাস্কাট পরে নাও লাইনা।
মহাকাশযান থেকে সুহান অনায়াসে লাফিয়ে নেমে আসে। লাইনা ইতস্তত করছিল। সুহান হাত বাড়িয়ে বলল, ভয় নেই, আমি আছি।
লাইনা সুহানের হাত ধরে নেমে আসে। দুজনে গুড়ি মেরে সরে যেতে থাকে। মহাকাশযানের সেন্সরগুলো কোথায় আছে সুহান জানে। জেনারেটরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে বলে সেগুলো এখন ঘুরে ঘুরে চারদিকে লক্ষ করছে না, কিন্তু সুহান কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। এই মহাকাশযান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত দূরে চলে যাওয়া যায়। পাথরের উপর লাফিয়ে সুহান অভ্যস্ত পায়ে ছুটতে থাকে, লাইনা বার বার পিছিয়ে পড়ছিল। পিছনে গ্রহের লালচে আলোতে মহাকাশযানটিকে কেমন জানি ভূতুড়ে মনে হয়।
সামনে একটা বড় পাথর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুহান তার আড়ালে লুকিয়ে পড়তে চাইছিল, তখন হঠাৎ লাইনা পিছন থেকে তার পিঠ খামচে ধরল। আর্ত চিৎকার করে বলল, সুহান, কী হয়েছে?
ওই দেখ।
সুহান মাথা তুলে তাকায়। সামনে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে উদ্যত অস্ত্র তাদের দিকে তাক করা। ছায়ামূর্তিটি এক পা এগিয়ে এসে ধাতব কণ্ঠে বলল, সুহান! আমি তোমার মৃতদেহ নিতে এসেছিলাম। মানুষের মৃতদেহ সমাহিত করতে হয়।
সুহান আনন্দে চিৎকার করে বলল, ট্রিনি!
হ্যাঁ। তোমার সাথে কে?
লাইনা।
আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ধন্য অনুভব করছি মহামান্যা লাইন।