সুহান তার খাবারের টেবিল থেকে একটা চামচ তুলে নেয়, তারপর রবোটের পিছনে দাঁড়িয়ে চামচটা দিয়ে তার হাতের বুড়ো আঙুলের নখটা ঢেকে ফেলে। সাথে সাথে রবোটটি বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যায় এবং পাগলের মতো তার দিকে ছুটে আসে। সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে রবোটটি দেখতে পেল বলে মনে হল না, তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে শুরু করল।
সুহান তার নখের উপর থেকে চামচটা সরিয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার?
আপনাকে খুঁজছিলাম, মহামান্য সুহান। মুহূর্তের জন্যে আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন।
না, আমি হারাই নি। আমি এখানেই আছি।
উত্তেজনায় সুহানের বুক কাঁপতে থাকে। এই ঘর থেকে পালিয়ে যাবার চমৎকার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। তার বিছানার উপর পালসারটি রেখে সে দরজার কাছে যাবে। চামচটিকে একটা হাতের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এলার্মটি বন্ধ করে দেবে। তারপর দরজা খুলে লেজাররশ্মিটি কোন বিন্দু থেকে বের হচ্ছে বের করে সেটি চামচ দিয়ে ঢেকে দেবে। চামচটি চকচকে, লেজাররশ্মি সহজেই প্রতিফলিত হয়ে যাবে। তারপর সে লাফিয়ে এই ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। এই মহাকাশযানটি ঠিক তার মহাকাশযানের মতো। একবার বের হতে পারলে কোনদিকে যেতে হবে সে জানে।
তাকে এই মুহূর্তে কেউ লক্ষ করছে কি না সে জানে না। সম্ভবত উপরে কোনো ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে সে এখন চিন্তা করবে না। সুহান তার কাজ শুরু করে দিল।
তিন মিনিট পর মহাকাশযানের করিডোর ধরে সুহানকে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যেতে দেখা গেল।
০৪.
মহাকাশযানের তিনটি জেনারেটর নিচে। ঘরটি নির্জন, কোনো মানুষজন নেই। পারমাণবিক শক্তি দিয়ে জেনারেটরগুলো চালানো হয়। প্রথম জেনারেটরটি সর্বক্ষণ চলতে থাকে। কোনো কারণে সেটি অকেজো হয়ে গেলে দ্বিতীয় জেনারেটরটি চলতে শুল্ক করে। সম্ভাবনা খুব কম কিন্তু যদি কোনো কারণে একই সাথে প্রথম এবং দ্বিতীয়, দুটি জেনারেটরই অকেজো হয়ে যায়, তখন তৃতীয় জেনারেটরটি চলতে শুরু করে। যদি কোনোভাবে তৃতীয় জেনারেটরটিও অকেজো হয়ে যায় তখন মহাকাশযানের সংরক্ষিত এই ব্যাটারিগুলো কাজ করতে ক্ষ করে। এই ব্যাটারিগুলো দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু তার মাঝে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ খুব কম। তখন মহাকাশযানের অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়া হয়। মহাকাশযানের বেশিরভাগ আলো নিভে যায়, কম্পিউটারে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণটুকু চাল রাখা হয়, কায়োজেনিক ঘরে অপ্রয়োজনীয় শীতলতা দূর করে দেয়া হয়। ভ্রূণ এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণ রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়া হয়। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে তিনটি জেনারেটরই একসাথে অকেজো হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে নি। সুহান জেনারেটর তিনটির সামনে দাঁড়িয়ে এই ইতিহাস তৈরি করার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
প্রথম জেনারেটরটি চলছে বলে সেটি অকেজো করা সহজ নয় কিন্তু অন্য দুটি খুব সহজে অকেজো করে দেয়া যায়। বিদ্যুতের যে লাইন রয়েছে সেগুলো ঠিক গোড়াতে কেটে দিতে হবে। সেগুলো কাটার যন্ত্রপাতি ঘরটিতে পাওয়া গেল। সেগুলো রবোটেরা ব্যবহার করে বলে অনেক বড় এবং ভারি। টেনেহিঁচড়ে সে যন্ত্রগুলো এনে বৈদ্যুতিক তারগুলো কেটে দিতে শুরু করে। দূরে নিশ্চয়ই কোথাও কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে রু করেছে। কিন্তু সমস্যাটি আবিষ্কার করে রবোটদের এখানে পৌছাতে পৌছাতে সে অনেকগুলো মূল্যবান সেকেন্ড পেয়ে যাবে।
সুহান প্রথম জেনারেটরটির সামনে এসে দাঁড়াল। জেনারেটরটি প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে, ভেতরের গরম বাতাস বের হওয়ার জন্যে উপরের খানিকটা অংশ খোলা। নিরাপত্তার জন্যে সেটার কাছে যাওয়ার উপায় নেই। সুহান নিরাপত্তার অংশটুকু অকেজো করে দিয়ে এগিয়ে যায়। তার যখন দশ বছর বয়স সে তখন প্রথম জেনারেটরটি কৌতূহলী হয়ে অকেজো করেছিল। ব্যাপারটি সে খুব ভালো করে জানে।
সুহান জেনারেটরের খোলা অংশের ঢাকনাটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলতে শুরু করে। ঠিক তখন সে উপরে রবোটের পদক্ষেপ শুনতে পায়। আর বেশি দেরি করা ঠিক নয়। ভারি একটা ট্রান্সফর্মার দুই হাতে তুলে নিয়ে সে জেনারেটরের ভেতরে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণায়মান শ্যাফটের মাঝে ফেলে দিল।
সাথে সাথে যে ব্যাপারটি ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণে বিশাল জেনারেটরটি কেঁপে ওঠে। বিদ্যুতের প্রচণ্ড ঝলকানি, তীব্র আলো আর কানফাটা শব্দে সমস্ত ঘরটি থরথর করে কেঁপে ওঠে। ধাতুর টুকরো চারদিকে উড়তে থাকে, ছোট একটি আগুন জ্বলতে শুরু করে এবং হঠাৎকরে মহাকাশযানের সমস্ত আলো নিভে গভীর অন্ধকারে চারদিক ঢেকে যায়। মহাকাশযানের অসংখ্য যন্ত্রপাতি থেমে গিয়ে হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে আসে।
সুহান কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে, ছোট আগুনটি তার নেভানোর প্রয়োজন নেই, রবোটদের সেটি আরো কিছুক্ষণ ব্যস্ত রাখতে পারবে। সে ঘোট একটি ঢাকনা খুলে একটি ছোট টানেলে ঢুকে যায়। এই ধরনের মহাকাশযানের খুঁটিনাটি তার থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না।
৫.
লাইনা তার ঘরে জানালার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত মহাকাশযান গভীর অন্ধকারে ঢেকে আছে, যন্ত্রপাতির কোনো শব্দ নেই। এই নৈঃশব্দ্য এক ধরনের আতঙ্ক জাগিয়ে দেয়। কিন্তু লাইনার বুকে কোনো আতঙ্ক নেই। সে নিশ্চিত নয় কিন্তু তার ধারণা, এটি দুর্ঘটনা নয়। এটি খুব ঠাণ্ডা মাথায় কেউ করেছে। এই ধরনের কাজ খুব ঠাণ্ডা মাথায় শুধুমাত্র একটি মানুষ করতে পারে, সে হচ্ছে সুহান। যে মানুষ কোন যন্ত্র কেমন করে কাজ করে জানে শুধু সেই মানুষই সেই যন্ত্র এত সহজে ধ্বংস করতে পারে। লাইনা তাই তার ঘরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে জানে না কেন, কিন্তু তার মনে হচ্ছে সুহান এখানে অসিবে।