কিরি লম্বা পা ফেলে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ থেমে সুহানের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, সুহান, তোমার সাথে সম্ভবত আমার আর দেখা হবে না। তোমাকে একটা জিনিস বলা প্রয়োজন। তুমি মনে করছ তোমার মৃত্যু–
সুহান চিৎকার করে বলল, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।
কিন্তু–
বের হয়ে যাও। তুমি বের হয়ে যাও
কিরি বের হয়ে গেল। সাথে সাথে সুহান ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠল। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে বিছানায় মাথা গুজে আহত পশুর মতো ছটফট করতে থাকে। তার বুকে গভীর হতাশা, গভীর যন্ত্রণা—যে অনুভূতির সাথে তার পরিচয় নেই। সে ফিসফিস করে বলল, ট্রিনি! ট্রিনি তুমি কোথায়?
লাইনার ঘরে চতুষ্কোণ স্ক্রিনে হঠাৎ কিরির ছবি ফুটে ওঠে। লাইনাকে ডেকে বলল, লাইনা।
বল।
আমি তোমাকে একটি জিনিস দেখাতে চাই।
লাইনার বুক কেঁপে উঠল হঠাৎ। ভয় পাওয়া গলায় বলল, না, আমি দেখতে চাই না।
তোমাকে দেখতে হবে লাইনা।
না। লাইনা চিৎকার করে বলল, না—
কিরি লাইনার কথা শুনল না। স্ক্রিনে সুহানের ছবি ভেসে উঠল। বিছানায় মাথা গুজে ফুলে ফুলে কাদছে। অসহায় একটি কিশোর। অসহায়, ভীত একটি কিশোর। যে মানুষের আশ্রয়ে ছুটে এসেছিল, যে মানুষ তাকে রক্ষা করতে পারে নি।
লাইনা হিংস্র দৃষ্টিতে স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আর দেখতে পারছে না, টেবিল থেকে চতুষ্কোণ কমিউনিকেশান মডিউলটি তুলে সে স্ক্রিনটির দিকে ছুড়ে দেয়। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে পড়ে স্ক্রিনের স্বচ্ছ কাচ। কয়েকবার কেঁপে কেঁপে ছবিটা অদৃশ্য হয়ে যায় স্ক্রিন থেকে।
০৩.
সুহান কতক্ষণ বিছানায় মাথা গুঁজে ছিল সে জানে না। হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর শুনে সে ঘুরে তাকায়, রবোর্টটি কিছু খাবার নিয়ে এসেছে।
আমাকে তাহলে এই মুহূর্তে মারবে না, সুহান নিজেকে বোঝাল, তাহলে এখন খাবার এনে হাজির করত না। কিংবা কে জানে হয়তো পরিপাকযন্ত্র কীভাবে কাজ করে জানতে চাইছে, তাই খাবারটা মুখে দেয়ামাত্রই মেরে ফেলবে।
আপনার খাবার, মহামান্য সহান। রবোটটি দ্বিতীয়বার কথা বলল, যান্ত্রিক একঘেয়ে গলার স্বর। সুহান খাবারগুলোর দিকে তাকাল। সে তার মহাকাশযানের রসদ থেকে যে ধরনের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত তার থেকে একটু ভিন্ন ধরনের। অন্য সময় হলে সে খাবারগুলো কৌতূহল নিয়ে দেখত, এখন কোনো কৌতূহল নেই। খাবারগুলো দেখে হঠাৎ সুহান বুঝতে পারে সে ক্ষুধার্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। সে রবোটটিকে বলল, তুমি খাবারটি রেখে চলে যাও।
আমার চলে যাওয়ার নির্দেশ নেই।
তোমার কিসের নির্দেশ রয়েছে?
আপাতত আপনার জন্যে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
তাহলে দাঁড়িয়ে থাক।
আপনার খাবার, মহামান্য সুহান।
সুহান বুঝতে পারে এটি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট। হঠাৎ করে তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। এই নির্বোধ রবোটটিকে কি কোনোভাবে ধোকা দেয়া সম্ভব?
সুহান আবার রবোটটির দিকে ঘুরে তাকাল, চতুষ্কোণ দেহ, বর্তুলাকার মাথা, উপরের অংশটুকু সম্ভবত চোখ, পায়ের নিচে চাকা, সম্ভবত সহজে সমতল জায়গার বাইরে যেতে পারে না। সুহান ট্রে থেকে এক টুকরা তুলে নিয়ে বলল, তুমি কোন শ্রেণীর রবোট?
উত্তর দেয়ার অনুমতি নেই, মহামান্য সুহান।
তুমি কি আমাকে চোখে চোখে রাখছ?
হ্যাঁ, মহামান্য সুহান।
সুহান হেঁটে রবোটটির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, রবোটটি কিন্তু সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে তাকাল না। সুহান বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে নেই, আমি ইচ্ছে করলেই দরজা খুলে বের হয়ে যেতে পারি।
রবোটটি তখন সুহানের দিকে ঘুরে তাকাল, তারপর বলল, মহামান্য সুহান, দরজার সাথে এলার্ম লাগানো হয়েছে। আপনি খুলে বের হতে পারবেন না। তাছাড়া দরজায় শক্তিবলয় লাগানো হয়েছে, আপনি বের হওয়ার চেষ্টা করলে আপনার শরীরে আনুমানিক তিন শ চৌত্রিশটি ফুটো হয়ে যাবে।
তিন শ চৌত্রিশটি?
জি, মহামান্য সুহান।
সুহান দরজাটির দিকে তাকাল। দরজার সাথে একটি এলার্ম লাগানো হয়েছে দেখা যাচ্ছে। সেটি বিকল করা কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দরজা খোলার পর সম্ভবত অন্য পাশে রবোটটির শক্তিবলয় ব্যাপারটি দেখা যাবে। শক্তিবলয় কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হতে পারে। উচ্চচাপের বিদ্যুৎ বা অদৃশ্য লেজার সম্ভবত এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু রববাটটি জানে, বের হওয়ার চেষ্টা করলে তার শরীরে তিন শ চৌত্রিশটি ফুটো হয়ে যাবে, এটি সম্ভবত লেজার রশ্মি, দরজার দুই পাশে প্রতিফলিত হয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে বের হচ্ছে জানতে পারলে একটি চকচকে জিনিস দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে আটকে রাখা যায়।
কিন্তু দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে রবোটটিকে ধোকা দিতে হবে। সেটি কেমন করে করা হবে?
সুহান আবার রবোটটির পিছনে হেঁটে গেল, রবোটটি সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে গেল। সুহান জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনো আমার দিকে লক্ষ রাখছ?
রাখছি, মহামান্য সুহান।
কেমন করে? তুমি আমার দিকে তাকিয়ে নেই।
আপনার দিকে না তাকিয়েও আমি আপনার দিকে লক্ষ রাখতে পারি মহামান্য সুহান।
সুহান ঘরে পায়চারি করতে থাকে। এটি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট, তাকে লক্ষ রাখার জন্যে অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর একটি পদ্ধতি ব্যবহার করছে। পদ্ধতিটি কী হতে পারে?
হঠাৎ সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে, পালসার! তার শরীর থেকে পালসারটি বের করে সেটি কোথায় রাখা যায় চিন্তা করে না পেয়ে আপাতত তার বুড়ো আঙুলের নখে একটা টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। পালসারটির কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। একটু আগে কিরি যখন এর কথা উল্লেখ করেছিল সে বুঝতে পারে নি। কিউ-২২ রবোটগুলো তাই এত সহজে তাকে তার ইঞ্জিনঘরে খুঁজে পেয়েছিল। এখন এই রবোটটি নিশ্চয়ই সব সময় তার পালসারের সঙ্কেতটুকু লক্ষ করছে। ব্যাপারটি সত্যি কি না খুব সহজে পরীক্ষা করা যায়। রবোটটির পিছনে গিয়ে তার নখে লাগানো পালসারটি একটা ধাতব কিছু দিয়ে ঢেকে ফেলবে। রবোর্টটি তখন নিঃসন্দেহে তার দিকে ছুটে আসবে।