ট্ৰিনি পাশের ঘরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চতুর্থ প্রজাতির কিউ-২২ রবোটের উপস্থিতিতে সে একটি জড় পদার্থ। বাধা দেয়া দূরে থাকুক, তার একটি আঙুল তোলারও ক্ষমতা নেই। সুহানের কাতর কণ্ঠস্বর শুনে তার কপোট্রনে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে, ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঝটকা দিয়ে কেঁপে উঠতে থাকে, সেটিকে সে থামানোর কোনো চেষ্টা করে না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, সুহানের দেহকে দুপাশ থেকে ধরে দুটি রবোট তাদের বাই ভার্বালে উঠে যাচ্ছে। শক্তিশালী ইঞ্জিনকে গুঞ্জন করে উঠতে শুনল সে। তারপর সেটিকে মিলিয়ে যেতে দেখল দূরে।
ট্ৰিনি শূন্য ঘরটিতে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে বেড়াল। ঘরে সুহানের ছড়ানো ছিটানো যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে তুলে রাখল। তার শরীর থেকে বের করা পালসারের বাক্সটি দেখে মনে পড়ল, পালসারটি সুহানের কাছে রয়ে গেছে। কোথায় রাখা যায় ভেবে না পেয়ে গত রাতে সুহানের নখে টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। সুহানের নিও পলিমারের কাপড় পরিষ্কার করতে নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রিনি হঠাৎ করে বুঝতে পারল, এই কাজটি অর্থহীন। সুহান আর কখনো এই ঘরে ফিরে আসবে না। ট্রিনি আবিষ্কার করে, তার আর কিছু করার নেই।
সে ঘরের ঠিক মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
০২.
ঘুম ভাঙার পর সুহানের অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে সে কোথায়। চোখের সামনে সবকিছু ধোয়াটে, যেন হালকা কুয়াশার আস্তরণ। কোথায় যেন কর্কশ একটা শব্দ হচ্ছে। তার শরীর শীতার্ত, মাথার মাঝে এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা। কপালের কাছে একটা শিরা দপদপ করছে। সুহানের প্রথমে মনে হল সে মারা গেছে, কিন্তু মৃত মানুষের কি মাথায় যন্ত্রণা হতে পারে?
সুহান আবার ভালো করে চোখ খুলে তাকাল। না, সে মারা যায় নি। মাথার কাছে মনিটরে আলো জ্বলছে। তার শরীরে নানা ধরনের সেন্সর লাগানো। সেগুলো থেকে নানারকম সঙ্কেত বিচিত্র যন্ত্রপাতিতে যাচ্ছে। মনিটরে তার তাপমাত্রা, রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, মেটাবলিজম থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের কম্পন পর্যন্ত লক্ষ রাখা হচ্ছে। মৃত মানুষের শরীরে কোনোকিছু লক্ষ রাখার প্রয়োজন হয় না।
সুহান উঠে বসে। বেশ বড় একটা ঘর। ঘরের দেয়াল ধবধবে সাদা। সারা ঘরে এক ধরনের নরম আলো, অনেকটা দ্বিতীয় সূর্যের আলোর মতো। আলোটা কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। সুহান নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে হ্যাচকা টান দিয়ে সবগুলো সেন্সর খুলে ফেলল। সাথে সাথে দূরে কোথাও তীক্ষ একটা শব্দ হতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই প্রথমে একটি রবোট এবং তার পিছু পিছু একজন দীর্ঘকায় মানুষ প্রবেশ করে। সুহান মানুষটিকে চিনতে পারল, মহাকাশযানের দলপতি কিরি এবং সাথে সাথে তার মনে পড়ল, মানুষের মতো দেখালেও কিরি একটি রবোর্ট।
কিরি সুহানের কাছে এসে বলল, শুভ সন্ধ্যা সুহান।
সুহান কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শরীর এখনো দুর্বল। মস্তিক হালকা, মনে হতে থাকে পৃথিবীর কোনোকিছুতেই কিছু আসে যায় না। কিরির দিকে তাকিয়ে সে নিজের ভিতরে এক ধরনের বিজাতীয় ঘৃণা অনুভব করতে থাকে। কিরি আরেকটু এগিয়ে এসে আবার বলল, শুভ সন্ধ্যা সুহান।
সন্ধ্যাটি কি সত্যিই আমার জন্যে শুভ?
কিরি শব্দ করে হেসে বলল, শুভ-অশুভ খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। একজনের কাছে যেটি শুভ, অন্যজনের কাছে সেই একই ব্যাপার
সুহান কিরির আপাতদার্শনিক উত্তরে বাধা দিয়ে বলল, তুমি সত্যিই আমাকে মেরে ফেলবে?
কিরি তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। সুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রবোটেরা মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তুমি তাহলে কেমন করে একজন মানুষের ক্ষতি করতে পার?
কিরি অন্যমনস্কের মতো বলল, ব্যাপারটা খুব জটিল। মানুষ কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। শুধু জৈবিকভাবে মানুষ হলেই হয় না। মানুষ হতে হলে পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্রে তার জন্ম-পরিচয় থাকতে হয়। তোমার সেই পরিচয় নেই, তাই তোমার সাথে একটা বন্যপশুর কোনো পার্থক্য নেই।
যদি তথ্যকেন্দ্রে জন্ম-পরিচয় থাকত?
তাহলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতে পারত।
সুহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে তুমি তোমার মহাকাশযানের মানুষদের সাথে দেখা করতে দেবে?
না।
কেন নয়?
সেটি পুরো ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে দেবে।
সুহান আর কোনো কথা বলল না। কিরি ঘরে ইতস্তত হেঁটে এসে বলল, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তোমাকে আমি যত সহজে ধরে আনব ভেবেছিলাম তত সহজে ধরে আনতে পারি নি। তুমি সত্যি সত্যি আমাকে ধোকা দিতে পেরেছিলে। পুরো ব্যাপারটা যখন দ্বিতীয়বার চিন্তা করেছি তখন বুঝতে অসুবিধে হয় নি যে, পালসারটা তোমার শরীরেই আছে, তুমি দ্বিতীয় একটি পালসার গ্রহের সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলে পাঠিয়েছ—
আমাকে কি তুমি একা থাকতে দেবে?
কিরি একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ। সুহান ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি নিম্ন শ্রেণীর রবোটকে দেখিয়ে বলল, তুমি যাবার সময় কি ওই রবোর্টটাকেও নিয়ে যাবে? তোমাদের রবোটদের আমার ভালো লাগে না।
কিরির মুখে অপমানের ছায়া পড়ল, তাকে এর আগে অন্য কেউ একটি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের সাথে এক করে দেখে নি। সে শক্তমুখে বলল, এই রবোর্টটি তোমাকে চোখে চোখে রাখবে। সে তোমার সাথে এই ঘরে থাকবে। আমি যাচ্ছি, তোমাকে একা থাকতে দিচ্ছি।