তোমার তাই মনে হয়?
হ্যাঁ। চমৎকার একটা জীবন। তীব্র জীবন।
সুহান, আমি তোমাকে কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারি নি। আগে তবু বেশ অনেকখানি বুঝতে পারতাম। গত কয়েকদিন থেকে তোমাকে একটুও বুঝতে পারি না। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি যেটা চাও সেটাই আমি করব। আমি কখনো বুঝতে পারব না কেন করছি, তবু করব।
ধন্যবাদ ট্রিনি। তুমি হচ্ছ আমার সত্যিকারের বন্ধু।
শুধু একটি ব্যাপার–
কী?
আমার মনে হয় আমাদের চেষ্টা করা উচিত আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনাকে আরো একটু বাড়ানো।
তুমি কীভাবে সেটা করবে?
অনেকভাবে করা যায়। আমাদের মহাকাশযানটি ঠিক অন্য মহাকাশযানটির মতো।
আমরা এর খুঁটিনাটি দেখতে পারি। কোথাও কোনো গোপন পথ আছে কি না বের করতে পারি। মহাকাশযানের বাইরে ছোট একটা স্টেশন করে ভেতরের কথাবার্তা হুনতে পারি, তাদের দৈনন্দিন রুটিন সম্পর্কে ধারণা করতে পারি, নতুন ধরনের কয়েকটা অস্ত্র তৈরি করতে পারি। তারপর কোনোভাবে লাইনাকে মহাকাশযানের বাইরে আসার জন্যে খবর পাঠাতে পারি, সে বাইরে এলে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি।
সুহানের মুখে একটা ছেলেমানুষি হাসি ফুটে উঠল, বলল, আমি আর লাইনা। লাইনা এবং আমি।
এবং আমি।
হ্যাঁ, আর তুমি। অবশ্যি তুমি।
০৪.
ইঞ্জিনিয়ার গ্রুসো তার অস্ত্রটি করিডোরের রেলিঙে শক্ত করে আটকে নিল। এটি এমন কিছু ভারি অস্ত্র নয় কিন্তু সে কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। অস্ত্রটি শক্তিশালী। লক্ষ্যবস্তুকে দৃষ্টিবদ্ধ করার জন্যে তিনটি ভিন্ন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা রয়েছে। ইনফ্রায়েড এবং আলট্রাভায়োলেট রশ্মি, তার সাথে সাথে একটি মাইক্রোওয়েভ সঙ্কেত। লক্ষ্যবস্তুকে দৃষ্টিবদ্ধ করার সাথে সাথে দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিস্ফোরক ছুটে যাবে দুই মাইক্রোসেকেন্ড ধর পর, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে লক্ষ্যবস্তু। গ্রুসো পুরো ব্যাপারটা অনেকবার চিন্তা করে দেখেছে, ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার লক্ষ্যবস্তু এই মহাকাশযানের দলপতি দশম প্রজাতির রবোট কিরিকে সে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করবে। গ্রুসোর মনে সেটা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই।
সে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে কন্ট্রোল রুম থেকে এক্ষুনি কিরি বের হবে, ঠিক এ রকম সময়ে সে বের হয়। গ্রুসো ট্রিগারে আঙুল রেখে স্থির চোখে সামনে তাকিয়ে থাকে। নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট।
০৫.
গ্রুসোর মৃতদেহকে ঘিরে মহাকাশযানে সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিরি ঝুঁকে পড়ে তাকে এক নজর দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম।
কেউ কোনো কথা বলল না। কিরি সবার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমাকে কোনো অস্ত্র দিয়ে দৃষ্টিবদ্ধ করা যায় না। অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আমার কাছে চলে আসে। আমার দিকে যে বিস্ফোরক পাঠানোর কথা সেটি নিজের কাছে ফিরে যায়। আমি চাইলেও যায়, আমি না চাইলেও যায়।
সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেউ একজন গ্রুসোর চোখ দুটি বন্ধ করে দেবে? মৃত মানুষ তাকিয়ে থাকলে খুব ভয়ঙ্কর দেখায়।
কেউ এগিয়ে গেল না।
০৬. দুঃস্বপ্ন
সুহানের ঘুম ভাঙল বিচিত্র শব্দ শুনে, শব্দটি সে ধরতে পারল না। আধো ঘুমের মাঝে শব্দটি কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল, তখন সে দ্বিতীয়বার শব্দটি শুনতে পেল। সুহান এবার চোখ খুলে তাকায়, তার দুপাশে দু জোড়া সবুজাভ চোখ। সে লাফিয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন সে একটি ধাতব কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, আমার মনে হয় এখন নড়াচড়া করা অত্যন্ত অবিবেচকের মতো কাজ হবে।
সুহান কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে শুরু স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে?
ঘরের একটা আলো জ্বলে ওঠে তখন। আলোটা কোথা থেকে আসছে সে ধরতে পারে না। তার পাশে দুটি রবোট। ট্রিনির মতো নয়, দেখতে অন্যরকম। দেহ আকারে আরেকটু ছোট, বুকের মনিটরটি আরো অনেক জটিল। দুটি রবোটের হাতেই একটি করে বিচিত্র অস্ত্র। অস্ত্র থেকে ছোট একটি আলো জ্বলছে এবং নিভছে, নিঃসন্দেহে তাকে দৃষ্টিবদ্ধ করা আছে, একটু ভুল হলেই শেষ করে দেবে। সুহান বিছানায় বসে আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে?
মহামান্য কিরি আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে।
আমি যদি যেতে না চাই?
আপনাকে শক্তি প্রয়োগ করে নেয়া হবে।
রবোটদের নীতিমালায় লেখা আছে তাদের মানুষের কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই কিন্তু সে কথাটি তাদের বলা নিশ্চয়ই অর্থহীন। কিরি নিঃসন্দেহে তাদের অন্যভাবে প্রোগ্রাম করে রেখেছে। সুহানের হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে। তার জীবনে সে ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে খুব কম, ব্যাপারটির সাথে তার ভালো পরিচয় নেই।
একটা রবোট হঠাৎ তার উপর ঝুঁকে পড়ল। সুহান তার শুকনো ঠোঁট দুটি জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল, তুমি কী করছ?
আপনার শরীরে কন্ট্রালিনের একটি ইনজেকশান দিচ্ছি।
সেটি কী?
সেটি এক ধরনের ওষুধ। আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
আমি ঘুমাতে চাই না।
কিন্তু আমাদের ওপর সেরকম নির্দেশ।
সুহান দেখতে পায়, রবোর্টটি হাতে ছোট সিরিঞ্জের মতো কী একটা নিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়েছে। বাধা দেয়া অর্থহীন কিন্তু তার সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে রবোটটির হাত ধরে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। পারল না। তার কজিতে সুচ ফোটানোর তীক্ষ্ণ একটু যন্ত্রণা অনুভব করল। সুহান বুঝতে পারে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে, ভয়ঙ্কর হতাশায় সে ডুবে যাচ্ছিল, ফিসফিস করে বলল, ট্রিনি, তুমি কোথায়?