ট্ৰিনি মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয় সুহান। মনে হয়, আমি তোমাকে ঠিক করে বড় করতে পারি নি। মানুষের কাজকর্ম সম্পর্কে তোমার সম্মানবোধ খুব কম।
কমই তো, খুবই কম। বলতে গেলে কিছুই নেই। তা না হলে কি একটা মানুষের দলকে একটা রবোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?
ট্ৰিনি মাথা নাড়ে, তা ঠিক।
মানুষ অনেক ভুল করেছে ট্রিনি। মানুষ একটা কাজ করলেই সেটা ভালো, তুমি সেটা মনে কোরো না।
ট্রিনি হঠাৎ দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, নড়বে না সুহান, একেবারে নড়বে না। পালসারটা পিঠের কাছে উঠে এসেছে।
ট্রিনি দ্রুত একটা সিরিঞ্জ নিয়ে তার পিঠে একটা সুচ ফুটিয়ে দিল। সুহান মুখ বিকৃত করে যন্ত্রণার একটা শব্দ করে সঁতে দাঁত চেপে বলল, কী করছ ট্রিনি? তুমি জান না আমাদের স্নায়ু বলে একটা জিনিস আছে? আমাদের যন্ত্রণা বলে একটা অনুভূতি হতে পারে?
বাজে কথা বোলো না। একটা সুচ আর কত যন্ত্রণা দিতে পারে?
আমার ইচ্ছে করছে কোনোভাবে এক দিনের জন্যে তোমার শরীরে ব্যথা বোধ হত, আর আমি তোমার পিঠে ছয় ইঞ্চি একটা সুচ ফুটিয়ে দিতাম।
ট্রিনি বিড়বিড় করে বলল, আমি রবোট বলে মনে কোরো না আমার কোনোরকম সমস্যা নেই। তুমি যখন বিদঘুটে একটা সমস্যা হাজির কর যার কোনো সমাধান নেই, সেটা চিন্তা করে আমার কপোট্রনের ভোল্টেজ ওলটপালট হয়ে যায়। আমি শরীরের অংশবিশেষের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। মনে কোরো না সেটা খুব আনন্দের ব্যাপার। নড়বে না, একেবারে নড়বে না, পালসারটা প্রায় ধরে ফেলেছি।
কয়েক মুহূর্ত পরে ট্রিনি সিরিঞ্জটা টেনে বের করে আনে। ভিতরে একটু রক্ত, সেই রক্তে পালসারটা ভেসে বেড়াচ্ছে।
সুহান উপর থেকে তার হাতে তৈরী যন্ত্রটা ঠেলে সরিয়ে নিয়ে বলল, সত্যি বের করেছ তো?
হ্যাঁ। এই দেখ, সিরিঞ্জের ভেতর থেকে সিগনাল বের হচ্ছে। তিন মিলি সেকেন্ড পর পর বার মেগা হার্টজের সিগনাল।
চমৎকার! কী করবে এখন এটাকে?
এখান থেকে বের করে কোথাও রাখতে হবে।
রাখ। সুহান টেবিল থেকে নেমে বলল, শেষ পর্যন্ত এখন আমাকে মুক্ত মুক্ত মনে হচ্ছে। এখন বের হতে পারব।
ট্ৰিনি সাবধানে সিরিঞ্জ থেকে রক্তটা বের করতে করতে বলল, কোথায় বের হবে?
লাইনার সাথে দেখা করতে যাব।
হঠাৎ করে ট্রিনির ডান হাতটি অপ্রকৃতিস্থের মতোড়তে শুরু করে। সাবধানে সেটাকে থামিয়ে বলল, কার সাথে?
তুমি জান আমি কার কথা বলছি। লাইনা।
কেন?
কারণ আমার মনে হচ্ছে আমি লাইনার প্রেমে পড়েছি।
প্রেমে পড়েছ?
হ্যাঁ। প্রেম। একটা মানবিক ব্যাপার। তোমাদের রবোটদের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব নয়।
তুমি জান মহাকাশযানের দলপতি, দশম প্রজাতির রবোট কিরি তোমাকে হত্যা করার জন্যে খোজ করছে। তোমাকে ধরে নেয়ার জন্যে একটা কিউ-১২ রবোট পাঠিয়েছিল। সেটাকে কোনোভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন অন্য রবোটেরা খুঁজছে। তুমি বলছ তবু তুমি নিজে থেকে সেই মহাকাশযানে যাবে?
হ্যাঁ, আমার লাইনার সাথে দেখা করতে হবে।
ট্রিনির ডান হাতটা আবার দ্রুত নড়তে শুরু করে, বাম হাত দিয়ে সেটাকে ধরে রেখে বলল, তুমি জান তুমি যদি সেখানে যাও তোমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য এক।
সুহান অন্যমনস্কের মতো বলল, আমারও তাই মনে হয়। তাহলে?
সুহান কোনো উত্তর না দিয়ে হেঁটে এসে গোল জানালাটি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। বহুদূরে একটা আগ্নেয়গিরি থেকে লাল আগুন বের হচ্ছে, লাভা গড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তার লাল আভায় চারদিকে এক ধরনের রহস্যময় আলো।
ট্রিনি বলল, তুমি যে এখানে থাক সেটা কিরি জানে। তোমার তৈরী পালসারটি দিয়ে তাকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, কিন্তু সে কিছুদিনের মাঝেই সেটা জেনে যাবে। আমার মনে হয়, তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্যে এখানে থাকা ঠিক নয়। গ্রহের অন্যপাশে আমরা চলে যেতে পারি। মনে আছে একবার আমরা গিয়েছিলাম? চমৎকার কয়েকটা আগ্নেয়গিরি আছে সেখানে?
তুমি বলছ আমি পালিয়ে যাব?
হ্যাঁ। বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।
কেন?
ট্রিনির ডান হাতটি আবার দ্রুত নড়তে শুরু করে। কোনোভাবে সেটা বাম হাত দিয়ে ধরে রেখে বলল, হয়তো আবার কোনো মহাকাশযান আসবে, সেখানে নেতৃত্ব দেবে মানুষ, যেই মানুষ–
সুহান শুষ্ক স্বরে হেসে ওঠে। ট্রিনির সুহানের এই হাসির সাথে পরিচয় নেই। হঠাৎ করে কথা থামিয়ে সে চুপ করে গেল। সুহান হাসি থামিয়ে বলল, ট্রিনি, জীবনের অর্থ নয় যে সেটা খুব দীর্ঘ হতে হবে। জীবনটা ছোট হতে পারে কিন্তু সেই ছোট জীবনে থাকতে হবে তীব্রতা। থাকতে হবে আনন্দ। আমি যতদিন একা একা ছিলাম তখন ভেবেছিলাম, সারাদিন গ্রহে গ্রহে ঘুরে বেড়ানো, রাতে ছোট ছোট যন্ত্র তৈরি করা, মহাকাশযানের অসংখ্য যন্ত্রপাতি কীভাবে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করা, তোমার সাথে কথা বলা, নিশাচর প্রাণীর তালিকা তৈরি করা হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন। কিন্তু লাইনার সাথে দেখা হওয়ার পর আমার সবকিছু পাল্টে গেছে। এখন আমার আগের জীবনের জন্যে কোনো আকর্ষণ নেই। আমার নতুন জীবনে শুধু একটা জিনিস থাকতে পারে
সেটা কী?
লাইনা। তার সাথে আবার দেখা করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা। তাকে আর একবার স্পর্শ করা। তাকে ডাকে—সুহান অন্যমনস্কভাবে থেমে গেল। একটু পরে বলল, যদি সেটা করতে না পারি তাহলে আমি সেটা করার চেষ্টা করতে পারি। চেষ্টা করে যদি কোনোভাবে মারাও যাই, আমার মনে হয়, সেটাও হবে একটা চমৎকার জীবন।