ইচ্ছে করে তো আস নি। আশ্রয় নিতে এসেছিলে। আবার কেউ আসবে আশ্রয় নিতে।
ছাই আসবে। যদি আসে আবার তাদের মহাকাশযান ধসে পড়বে। আবার সবাই শেষ হয়ে যাবে।
তুমি তো শেষ হও নি।
আমার মায়ের পেট কেটে আমাকে তুমি যদি বের না করতে, আমিও শেষ হয়ে যেতাম।
ট্রিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, সুহান, ওই কথা থাক।
কেন ট্রিনি?
আমি দেখেছি, এই আলোচনা তোমার ভালো লাগে না।
আমার মাঝে মাঝে কিন্তু ভালো লাগে না ট্রিনি।
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ। একটা জীবন হচ্ছে একটা সংগ্রাম, একটা যুদ্ধ। যার যুদ্ধ যত কঠিন তার জীবন তত অর্থবহ। তোমার মতো এ রকম যুদ্ধ করে আর কে বেঁচে আছে বল? কেউ নেই।
ছাই যুদ্ধ!
ছিঃ সুহান, এ রকম বলে না।
কী হয় বললে?
এগুলো হচ্ছে মন খারাপ করার কথা। মন খারাপ করার কথা বলতে হয় না। একজন মন খারাপ করার কথা বললে অন্যজনেরও মন খারাপ হয়ে যায়।
কিন্তু তুমি তো রবোট। তোমার তো মন খারাপ হয় না।
হ্যাঁ, আমার মন খারাপ হয় না।
তাহলে তুমি কেন বলছ? তুমি কেন মানুষের মতো ব্যবহার করছ?
ট্রিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি যদি তোমার সাথে মানুষের মতো ব্যবহার করি, তুমি কোনোদিন জানবে না কেমন করে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। তুমি সব ভুল কথা বলে মানুষের মনে দুঃখ দিয়ে দেবে। তোমার সাথে কথা বলে মানুষের মন খারাপ হয়ে যাবে।
আমার কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হবে না। সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কের মতো বলল, আমার কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হবে না।
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না, ছিঃ! নিশ্চয়ই দেখা হবে।
সুহান ট্রিনির কথার উত্তর না দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল। দ্বিতীয় সূর্যটি পাহাড়ের আড়ালে ঢেকে গেছে। একটু পরেই গ্রহটি গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
০২.
পাথর বেয়ে নামতে নামতে সুহান তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে তাকায়। দ্বিতীয় সূর্য অস্ত যাবার পর হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। চারদিকে ইনফ্রা রেড আলো রয়েছে, বেশ খানিকটা আলট্রা ভায়োলেট আলো আছে। ট্রিনি পরিষ্কার দেখতে পায়, কিন্তু সুহান কিছু দেখতে পায় না। মানুষের চোখ এই আলোতে সংবেদনশীল নয়। কে জানে, মানুষের যদি এই গ্রহে জন্ম হত তাহলে হয়তো এই আলোতে তাদের চোখ সংবেদনশীল হত। কিন্তু মানুষের এই গ্রহে জন্ম হয় নি।
ট্ৰিনি নিচু গলায় বলল, সুহান।
কী হল?
তুমি ইনফ্রা রেড চশমাটি পরে নাও, তাহলে দেখতে পাবে। না দেখে তুমি কেমন করে যাচ্ছ? নাও–
না।
কেন নয়?
আমি আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি। ওই যে ডান দিকে একটা ক্লিও-৩২ বসে আছে। ঠিক কি না?
ঠিক, কিন্তু ইনফ্রা রেড চশমাটি পরে নাও, তাহলে আবছা নয়, স্পষ্ট দেখতে পাবে।
আমি পরতে চাই না ট্রিনি। কেন নয়?
আমি যন্ত্রে অভ্যস্ত হতে চাই না।
কেন নয় সুহান?
যন্ত্র কেমন করে কাজ করে জানতে আমার ভালো লাগে, কিন্তু ব্যবহার করতে ভালো লাগে না।
মানুষ মাত্রই যন্ত্র ব্যবহার করে সুহান। পৃথিবীর মানুষ সবসময় অসংখ্য যন্ত্র ব্যবহার করে। তোমাকেও ব্যবহার করতে হবে।
আমার যদি দরকার হয়, করব। কিন্তু এখন তো দরকার নেই। আমি তো আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে উত্তাপ বুঝতে পারি। সামনে আরেকটা নিওফিলিস রয়েছে, ঠিক কি না?
ঠিক।
ক্লিও-৩২টা নিওফিলিসের দিকে আসছে। মনে হয় নিওফিলিসটার কপালে দুঃখ আছে। খানিকটা অংশ ছিড়ে নেবে।
মনে হয়।
ডান দিক দিয়ে ঘুরে যাই, ক্লিও-৩২ প্রাণীটা একেবারে নির্বোধ। ভুল করে আমাকে
খামচে দেয়।
সুহান ডান দিক দিয়ে সরে গিয়ে পাথুরে রাস্তায় হাঁটতে থাকে। তার চারপাশে ইনফ্রা রেড আলোর জগতে একটি জীবন্ত গ্রহ। অসংখ্য জীবন্ত প্রাণী। নিশাচর প্রাণী। সুহান আর ট্রিনি মিলে প্রাণীগুলোর একটা তালিকা তৈরি করেছে। বেশিরভাগই নিরীহ প্রাণী, গোটা চারেক ঠিক নিরীহ নয়। এদের মাঝে একটি প্রাণীকে মোটামুটি ভয়াবহ বলা যায়। সুহান নাম দিয়েছে লুতুন। লুতুনের আকার বেশি বড় নয় কিন্তু মনে হয় প্রাণীটির খানিকটা বুদ্ধিমত্তা রয়েছে। অন্যান্য প্রাণী থেকে এটা অনেক দ্রুতগামী। সুহান ঠিক নিঃসন্দেহ নয় কিন্তু তার মনে হয় প্রাণীটা তাকে মাঝে মাঝেই আক্রমণ করার চেষ্টা করে। প্রাণীটা এই গ্রহের অন্যান্য প্রাণীদের মতোই, কিন্তু ট্রিনি দাবি করে, এই গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীর প্রাণী থেকে অনেক ভিন্ন। পৃথিবীর যে সমস্ত প্রাণী পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে তাদের দেহে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস বা পরিপাকযন্ত্র নির্দিষ্ট জায়গায় রয়েছে। এই গ্রহের প্রাণীদের বেলায় সেটি সত্যি নয়, তাদের মস্তি বা শ্বাসযন্ত্র সারা দেহে ছড়ানো। মানুষের মস্তিষ্ক বা কাপওে আঘাত করে তাকে যেরকম মেরে ফেলা যায়, এই প্রাণীগুলোর সেরকম কোনো জায়গা নেই। তাদের মস্তিষ্ক সারা দেহে বিস্তৃত, তাদের ইন্দ্রিয় শরীরের সর্বত্র। শরীরের যে কোনো অংশ খুলে ভয়াবহ পরিপাকযন্ত্র বের হয়ে আসে। ট্রিনির ধারণা, পৃথিবীর গাছের সাথে এদের মিল রয়েছে। পৃথিবীর গাছ অবশ্যি এক জায়গায় স্থির কিন্তু এই প্রাণীগুলো স্থির নয়। লুতুন প্রাণীটি ইচ্ছে করলেই ছুটে সুহানের সাথে পাল্লা দিতে পারবে।
চেনা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুহান হঠাৎ থেমে যায়। ট্রিনি বলল, কী হল সুহান?
লুতুন? কোথায়?
সুহান শুনতে পেল, ট্ৰিনি তার সংবেদনশীল চোখকে আরো সংবেদনশীল করে ফেলেছে। তার চোখের ভিতর থেকে ক্লিক ক্লিক করে এক রকমের শব্দ হতে থাকে।