কিরির গলার স্বর আশ্চর্য রকম শান্ত। সেখানে এক ধরনের অশরীরী শীতলতা রয়েছে, যেটি শুনে সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে খানিকক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে থেকে কোমল গলায় বলল, তোমাদের কারো কোনো প্রশ্ন আছে?
কেউ কোনো কথা বলল না।
কিরি শান্ত গলায় বলল, তোমরা এখন যেতে পার।
ঘরের সব মানুষ এক জন এক জন করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। গ্রুসো বের হবার আগে হঠাৎ একবার কিরির দিকে ঘুরে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে কিরিকে। যাকে মাত্র এক দিন আগেও সে নিজের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে জেনেছে।
কিরি হঠাৎ বলল, গ্রুসো।
গ্রুসো থমকে দাঁড়াল।
লাইনা কেমন আছে?
ভালো আছে। করোটিতে আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু বিপদ কেটে গেছে।
লাইনাকে বোলো আমি খুব দুঃখিত।
বলব।
গ্রুসো ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। কিরি বলল, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?
হ্যাঁ।
কী?
আমি কি তোমাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে পারি?
কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, না গ্রুসো। সেটা খুব অবিবেচকের মতো কাজ হবে। আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমাকে ধ্বংস করার কোনো পদ্ধতি আমার জানা নেই।
ও।
শুভ রাত্রি গ্রুসো।
শুভ রাত্রি।
০৫. ভালবাসা
বাই ভার্বালটি মাটি থেকে অল্প একটু উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সামনে কন্ট্রোল স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে সুহান। পিছনে ট্রিনি? বাই ভার্বালের যেটুকু গতিতে যাওয়ার কথা সুহান তার থেকে দ্বিগুণ বেগে ছুটে যাচ্ছে। ট্ৰিনি নিচু স্বরে বলল, ধীরে সুহান। খারাপ একটা দুর্ঘটনা হতে পারে।
সুহান কোনো উত্তর দিল না। বিপজ্জনক একটা পাথরকে পাশ কাটিয়ে গতিবেগ আরো বাড়িয়ে দিল। তার দুই চোখ একটু পর পর পানিতে ভরে আসছে, বুকের ভিতর আশ্চর্য এক ধরনের অভিমান। ঠিক কার ওপর অভিমান সে জানে না। এক ধরনের বিচিত্র আক্রোশে তার সমস্ত গ্রহ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়ার ইচ্ছে করছে।
ট্ৰিনি আবার বলল, সুহান, সাবধান সুহান। খারাপ দুর্ঘটনা হতে পারে।
হোক।
অবুঝ হয়ো না সুহান।
আমি বেঁচে থাকলেই কী আর মরে গেলেই কী! আমি মানুষ অথচ মানুষেরাই আমাকে মেরে ফেলতে চায়।
মানুষেরা তোমাকে মেরে ফেলতে চায় না, সুহান। তুমি জান, যে তোমাকে মেরে ফেলতে চায় সে একজন রবোট।
এতজন মানুষ মিলে একটি রবোটকে থামাতে পারে না?
দশম প্রজাতির রবোট—
ছাই দশম প্রজাতি!
ট্রিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, সুহান।
কী হল?
তোমার শরীরে কি কেউ কিছু প্রবেশ করিয়েছে?
সুহান অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি? কী প্রবেশ করাবে?
জানি না। কিছুক্ষণ হল তোমার শরীরের ভিতরে কিছু একটা চালু হয়েছে।
কী চালু হয়েছে?
জানি না। বার মেগা হার্টজের সিগনাল। তিন মিলি সেকেন্ড পর পর। আমার মনে হয় এটা একটা মাইক্রো পালসার। এটা তোমার শরীরে ঢােকানো হয়েছে তুমি কোথায় আছ সেটা খুঁজে বের করার জন্যে। নিশ্চয়ই মহাকাশযানের কেউ প্রবেশ করিয়েছে।
ওই মিডি রবোটটা। নিশ্চয়ই মিডি রবোটটা। আমাকে বলল আমার এক ফোটা রক্ত দরকার। পরীক্ষা করবে। রক্ত নেবার ভান করে নিশ্চয়ই শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটা রবোট যখন মিথ্যা কথা বলা শুরু করে তখন কেমন লাগে?
রবোট প্রকৃত অর্থে মিথ্যা কথা বলে না তারা কোন প্রজাতির তার ওপর নির্ভর করে তাকে যে নির্দেশ দেয়া হয় সেটি তাদের মানতে হয়।
ছাই নির্দেশ! বদমাইশ রবোট। বেজন্মা কোথাকার!
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ!
কেন বলব না? এক শ বার বলব। বেজন্মা বদমাইশ শয়তানের বাচ্চা—
ছিঃ! সুহান, ছিঃ!
সুহান স্পেকট্রাস এনালাইজারে তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া পালসারের সিগনালটি স্পষ্ট দেখতে পায়। তিন মিলি সেকেন্ড পর পর বার মেগা হার্টজের একটা সুনির্দিষ্ট সঙ্কেত। ট্রিনি খানিকক্ষণ সঙ্কেতটি দেখে বলল, তোমার পিছনে পিছনে কাউকে নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দিয়েছে। তোমাকে খুঁজে বের করতে বেশিক্ষণ লাগবে না।
সুহান ফ্যাকাশে মুখে ট্রিনির দিকে তাকাল। ট্রিনি বলল, ভয় পেয়ো না সুহান, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কী ব্যবস্থা হবে?
তোমাকে একটা ফ্যারাডে কেজে লুকিয়ে ফেলতে হবে।
এই মহাকাশযানটা একটা বিশাল ফ্যারাডে কেজ। আমি এখন সেখানে লুকিয়ে আছি, কোনো সঙ্কেত বের হচ্ছে না। কিরি খুব ভালো করে জানে আমি এর ভিতরে আছি। তুমি কি কোনোভাবে পালসারটা আমার শরীর থেকে বের করতে পারবে?
ট্ৰিনি সুহানকে পরীক্ষা করে বলল, পালসারটা অসম্ভব ঘোট। তোমার রক্তের মাঝে ভেসে ভেসে শরীরের মাঝে ঘুরছে। কিছুক্ষণ পর পর তোমার হৃৎপিণ্ডের ভিতর দিয়ে চলে যাচ্ছে। মাইক্রো সার্জারি ছাড়া এটা বের করা খুব কঠিন।
তুমি মাইক্রো সার্জারি করতে পার না?
এখন পারি না। কিন্তু কপোট্রনে ক্রিস্টাল ডিস্ক থেকে মাইক্রো সার্জারির অংশটুকু প্রবেশ করিয়ে নিলেই পারব। দেখতে হবে যন্ত্রপাতি কী কী আছে। একটু সময় নেবে।
আমাদের হাতে কি সময় আছে?
ট্ৰিনি তার কথার উত্তর না দিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। সুহান শুনতে পায়, ক্লিক ক্লিক শব্দ করে তার সংবেদনশীল সমস্ত ইন্দ্রিয় আরো সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। সুহান ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হল ট্রিনি?
একটা বাই ভার্বাল আসছে এদিকে।
বাই ভার্বাল?
হ্যাঁ, কেউ একজন তোমাকে ধরে নিতে আসছে সুহান।
সুহানের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে ওঠে। খানিকক্ষণ ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থেকে জোর করে নিজেকে শান্ত করে বলল, কতক্ষণ সময় আছে আমাদের হাতে?