সুহান লাইনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে পানি টলটল করছে। সে আগে কখনো মানুষকে কাঁদতে দেখে নি কিন্তু দেখেই সে বুঝতে পারল।
মহাকাশযানের দরজায় লাইনা তার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করে দরজা খুলে দিল। মহাকাশযানের দ্বিতীয় অধিপতি হিসেবে তার দুবার এই সংখ্যা ব্যবহার করার অনুমতি আছে। বিথ কাউন্সিলে তাকে এর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে। যদি জবাবদিহি তাদের মনঃপূত না হয়, তার সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে চিরদিনের জন্যে কোনো একটি ভূগর্ভস্থ শীতলঘরে সরিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই মুহুর্তে লাইনার সেসব কথা মনে পড়ল না। সে মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, প্রচও ঝড়ো বাতাসে সুহান হেঁটে যাচ্ছে। তার চুল উড়ছে, কাপড় উড়ছে বাতাসে। সুহান মুখ নিচু করে হাঁটছে। লাইনা দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু সে নিশ্চিতভাবে জানে সুহানের দুই চোখে পানি।
০৩.
নিজের ঘরে ফিরে এসে লাইনা আবিষ্কার করে সেখানে কিরি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। লাইনাকে দেখে সে ক্রুদ্ধ গলায় হিসহিস করে বলল, সুহান কোথায়?
নেই।
কোথায়?
আমি তাকে তার গ্রহে ফিরে যেতে দিয়েছি।
কেমন করে যেতে দিয়েছ?
আমি আমার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করেছি।
গোপন সংখ্যা ব্যবহার করেছ? কিরি মাথা নেড়ে বলল, তার ফল কী হতে পারে তুমি জান?
জানি।
আমি তোমাকে কী বলেছিলাম তোমার মনে আছে?
মনে আছে।
তুমি শুধু গোপন সংখ্যা ব্যবহার কর নি, সেটা ব্যবহার করেছ আমার আদেশ অমান্য করার জন্যে। তুমি জান আমার আদেশ অমান্য করা প্রথম মাত্রার অপরাধ?
সম্ভবত।
তুমি জান প্রথম মাত্রার অপরাধের শাস্তি কী?
লাইনা স্থির চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে শাস্তি দেবার ভয় দেখিয়ো না।
আমার কথার উত্তর দাও। তুমি জান?
জানি।
তুমি জান তোমাকে সেই শাস্তি দিতে আমার কপোট্রনের একটি ফ্রিকোয়েন্সিও এতটুকু নড়বে না? একটি সাইকেল বিচ্যুত হবে না?
আমি জানি কিরি।
কিরি এক পা এগিয়ে এসে লাইনার দিকে তাকায়। ঘরের আলো তির্যকভাবে তার মুখে পড়ছে। ভয়ঙ্কর ভাবলেশহীন একটা মুখ। হঠাৎ তার চোখ থেকে সবুজ এক ধরনের আলো বের হতে ব্রু করে। তাকে দেখাতে থাকে অশরীরী একটা প্রাণীর মতো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ লাইনা এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করে।
কিরি লাইনার কাছে এসে এক হাতে লাইনার মাথার পিছনে ধরে এক ধরনের অপার্থিব শক্তি প্রয়োগ করে নিজের কাছে টেনে আনে। তার মুখের কাছে নিজের মুখ নামিয়ে এনে হিসহিস করে বলল, আমার শরীর ইস্পাত, ক্রোমিয়াম আর ঝিলনিয়ামের একটা সঙ্কর ধাতুর তৈরী। উপরে বায়োপলিমারের একটা পাতলা আবরণ আছে। আমি ইচ্ছে করলে এক হাতে একটা লোহার বিম ভেঙে দু টুকরা করে ফেলতে পারি। তোমার খুলি ইচ্ছে করলে আমি ডিমের খোসার মতো দাঁড়িয়ে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে আমার আঙুল থেকে কয়েক মিলিয়ন ভোল্ট বের করে তোমার এই সুন্দর শরীরকে দূষিত অঙ্গারে পাল্টে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে তোমার শরীর আমি ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে দিতে পারি। সে জন্যে আমাকে কারো কাছে জবাবদিহি পর্যন্ত করতে হবে না। সেটা করতে আমার কপোট্রনে একটি সাইকেলও বিচ্যুত হবে না।
লাইনা ভয়ার্ত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না।
কিন্তু আমি তোমাকে এই মুহূর্তে শেষ করব না। কেন জান?
লাইনা মাথা নাড়ল, সে জানে না।
আমি তোমার হৃদয়হরণকারী সুহানের শরীরে একটি পালসার প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি। প্রতি তিন মিলি সেকেন্ডে একবার সেই পালসার বার মেগা হার্টজের একটা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। আমি জানি সে কোথায় যাচ্ছে। আমি যখন ইচ্ছে তাকে ধরে আনতে পারব। আমি চাই যখন তাকে আমি ধরে আনি তুমি যেন কাছাকাছি থাক।
লাইনা ফিসফিস করে বলল, কেন সেটা তুমি চাও?
তুমি জানতে চাও কেন?
হ্যাঁ।
কারণ দশম প্রজাতির রবোট মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষের যেরকম ক্রোধ হয়, ভয়ঙ্কর ঈর্ষা হয়, আমারও সেরকম ভয়ঙ্কর ক্রোধ হয়, ঈর্ষা হয়। মানুষ যেরকম প্রতিশোধ নেয় সেরকম প্রতিশোধ নিই–
কিসের প্রতিশোধ?
কিরি ক্রোধে চিৎকার করে বলল, তুমি জান না কিসের প্রতিশোধ? তুমি অবহেলায় আমাকে ছুড়ে ফেলে ছুটে গেলে একটি বাচ্চাছেলের কাছে?
অমানুষিক আতঙ্কে লাইনার হৃৎপিও থেমে যেতে চায়। হঠাৎ করে অনেক কিছু সে বুঝতে পারে, কিছু একটা বলতে যায়, কিন্তু তার আগেই কিরির শরীর থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি বের হয়ে আসে। লাইনা সমস্ত শরীরে এক ধরনের অশরীরী ঝাকুনি অনুভব করে, চামড়া পোড়ার একটি গন্ধ বের হয়, নীল আলো আর কালো ধোয়ার মাঝে তার সমস্ত শরীর একটি জড়বস্তুর মতো ছিটকে গিয়ে দেয়ালকে আঘাত করে। জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখতে পায় কিরি উদ্যত হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার আঙুলের মাথা থেকে বিদ্যুতের নীলাভ স্ফুলিঙ্গ তার পাশের বাতাসকে আয়নিত করতে করতে ছুটে যাচ্ছে।
০৪.
মহাকাশযানের মূল চত্বরটির একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে কিরি দাঁড়িয়ে আছে। তার একটি পা টেবিলের উপর। নিজের হাত দুটি সে অন্যমনস্কভাবে নাড়ছে, মাঝে মাঝেই সেখান থেকে নীলাভ বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসছে। কিরির মুখ ভাবলেশহীন, তার চোখ থেকে সবুজ এক ধরনের আলো বের হচ্ছে। সেই আলোটি হঠাৎ তাকে একটা অশরীরী রূপ দিয়েছে।
কিরির সামনে মহাকাশযানের সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও তাদের কাছে কিরি ছিল একজন ঘনিষ্ঠ মানুষ। এখন আর নয়। হঠাৎ করে মনে হচ্ছে তারা কিরিকে জানে না।