বল।
তুমি কোথায়?
এই তো এখানে। সুহান একটা পর্যবেক্ষণ টেবিলের নিচে অসংখ্য যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে বের হয়ে এল। তার হাতে চৌকোনো একটা বাক্স, সেখান থেকে নানা ধরনের তার এবং অপটিক্যাল ফাইবার ঝুলছে। লাইনা চিৎকার করে বলল, সাবধান! হাই ভোল্টেজ–
ভয় নেই। আমি অফ করে দিয়েছি।
অফ করে দিয়েছ? লাইনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সুহানের দিকে তাকাল, মনে হল সে ঠিক বুঝতে পারছে না সুহান কী বলছে। অবাক হয়ে বলল, কেমন করে করলে?
ভিতরে দুটি মাইক্রো সুইচ আছে। দেখেই বোঝা যায় হাই ভোল্টেজের জন্যে তৈরী, বিদ্যুৎ অপরিবাহী আস্তরণ খুব বড়। প্রথমটার তিন নম্বর পিন—
তুমি—তুমি কেমন করে জান?
দেখলেই তো বোঝা যায়। টেবিলটা উপরে উঠছিল না, নিশ্চয়ই স্টেপিং মোটরে গোলমাল। একা বসেছিলাম, তাই ভাবলাম ঠিক করে দিই।
ঠিক করে দিই? লাইনা তখনো বুঝতে পারছিল না, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি পর্যবেক্ষণ টেবিলের কন্ট্রোল ঠিক করে দিয়েছ?
পুরোটা এখনো ঠিক হয় নি। একটা বিদ্যুৎ পরিবাহী তার হলে—
তুমি বলতে চাও, কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রের কোনো সাহায্য ছাড়া তুমি জিনিস ঠিক করতে পার?
সুহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি জানি সেভাবে ঠিক করার কথা নয়, অযথা সময় নষ্ট হয়। ট্ৰিনি আমাকে বলেছে। মানুষদের অন্যভাবে কাজ করার কথা। কিন্তু আমার এভাবে কাজ করতে ভালো লাগে। একটা কৌতূহল হয়—
লাইনা তখনো ব্যাপারটি ধরতে পারছিল না। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি বলতে চাও কোন জিনিস কীয়ে কাজ করে তুমি জান?
মহাকাশযানের যেসব জিনিসপত্র আছে সেগুলো মোটামুটি জানি। আমার সময়ের অভাব ছিল না। তাই শিখেছি–
কিন্তু সেটা তো অবিশ্বাস্য! সেটা অসম্ভব।
আর আমাকে করতে হবে না। সুহান এক গাল হেসে বলল, এখন আমি মানুষের সাথে থাকব, মানুষের মতো ব্যবহার করব। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে, কিন্তু
লাইনার মুখ হঠাৎ রক্তহীন হয়ে যায়। কাতর গলায় বলল, সুহান–
কী? আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি সুহান। কী কথা?
আমি কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। খুব জরুরি কথা। বেশি সময় নেই, খুব তাড়াতাড়ি বলতে হবে।
সুহান লাইনার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন একটি অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে থাকে।
তুমি জান, আমাদের দলপতি একটি রবোট?
জানি। দশম প্রজাতির রবোট। আমাদের ধারণা ছিল দশম প্রজাতির রবোট ঠিক মানুষের মতো। কিন্তু একটু আগে আমি আবিষ্কার করেছি দশম প্রজাতির রবোটে একটি খুব বড় ত্রুটি আছে।
কী ত্রুটি?
যে মানুষ সম্পর্কে তথ্য মূল তথ্যকেন্দ্রে নেই তাকে সে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না।
তার মানে আমি–
হ্যাঁ, তোমাকে সে মানুষ হিসেবে মেনে নেয় নি। সে এখন তোমাকে তোমাকে লাইনা মুখ ফুটে কথাটি উচ্চারণ করতে পারে না।
আমাকে কী?
তোমাকে মেরে ফেলতে চায়।
মেরে ফেলতে চায়? সুহান এমনভাবে লাইনার দিকে তাকাল যেন লাইনার কোনো কথা বুঝতে পারছে না। অনেকটা অন্যমনস্কর মতো বলল, আমাকে মেরে ফেলতে চায়? আমাকে?
হা। তোমার শরীরে নাকি অনেক মূল্যবান তথ্য আছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে এই গ্রহে মানুষের বসতি হবে।
সুহান আবার বিড়বিড় করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে?
হ্যাঁ, সুহান। তোমার খুব বড় বিপদ।
সুহানের মুখে খুব ধীরে ধীরে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা এসে ভর করে। তার চোখ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে আসে। সে কেমন এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থ দৃষ্টিতে লাইনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, তোমরা, মানুষেরা সেই রবোটের কথা মেনে নিয়েছ।
লাইনা সুহানের কাঁধে হাত রেখে বলল, না সুহান, আমরা মেনে নিই নি। আমি তাই তোমার কাছে এসেছি। তোমাকে এক্ষুনি পালিয়ে যেতে হবে।
পালিয়ে যেতে হবে?
হ্যাঁ, যেভাবে পার। যত দূরে পার। কিরি দশম প্রজাতির রবোট। তার ভয়ঙ্কর ক্ষমতা সুহান। আমরা এখন তার হাতের মুঠোয়। আমাদের একটু সময় দাও। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করে আমরা কিছু একটা ব্যবস্থা করব। যতদিন সেটা করতে না পারছি তুমি লুকিয়ে থাকবে। তুমি এখানে আসবে না–
আমি এখানে আসব না? আমি মানুষ কিন্তু আমি মানুষের কাছে আসতে পারব না?
আমি—আমি খুব দুঃখিত সুহান।
সুহান কেমন জানি হাহাকার করে বলল, আমি একজন মানুষ, তবু একটি রবোটের জন্যে আমি মানুষের কাছে আসতে পারব না?
আমি খুব দুঃখিত সুহান। খুব দুঃখিত। কিন্তু এখন আমাদের কিছু করার নেই। তোমাকে এক্ষুনি পালিয়ে যেতে হবে। এক্ষুনি। আমি তোমাকে এখন মহাকাশযানের দরজা খুলে বের হয়ে চলে যেতে দিতে পারব। কিন্তু পরে কী হবে আমি জানি না। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে আস। এই মুহূর্তে–
সুহান লাইনার দিকে ঘুরে তাকাল। হঠাৎ তাকে আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, তুমি যাবে আমার সাথে?
আমি?
হ্যাঁ। তুমি। যাবে?
লাইনার মুখ গভীর বিষাদে ঢেকে যায়। সে এই অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরটির মুখ নিজের কাছে টেনে এনে তার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল, সুহান, বিশ্বাস কর, যদি সম্ভব হত আমি তোমার সাথে যেতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকে নিরাপদে এখান থেকে বের করে। দিতে পারব শুধু আমি। সেটা আমি শুধু করতে পারি ভিতরে থেকে–
তাহলে আমিও যাব না। রবোর্টটাকে আমি–
না সুহান, তুমি যাবে। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। যেভাবে হোক তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। একটা রবোটের হাতে আমি তোমাকে মরতে দেব না। কিছুতেই মরতে দেব না–