লাইনা চিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি? কী বলছ?
এখন তুমি সম্ভবত বুঝতে পারছ, আমাকে একজন রবোটকে কেন মহাকাশযানের দলপতি করা হয়েছে।
না। লাইনা দাতে দাত ঘষে বলল, বুঝতে পারছি না।
তুমি বুঝতে পারছ কিন্তু স্বীকার করতে চাইছ না। সুহান ছেলেটির জন্যে তোমার মতো আমারও মমতা আছে লাইনা। কিন্তু আমি আমার মমতাকে পাশে সরিয়ে আমার দায়িত্বে ফিরে যেতে পারি। আমার দায়িত্ব মানুষের জন্যে একটা নতুন বসতি তৈরি করা। রবোটের জন্যে নয়—মানুষের জন্যে। এই গ্রহে সেটি সম্ভব কি না কেউ জানত না। কিন্তু এখন আমি জানি সেটা সম্ভব হবে। সুহানের শরীর থেকে আমরা অমূল্য সব তথ্য পাব। জণগুলো বিকাশের সময় আমরা সেই তথ্য ব্যবহার করব
লাইনা দুই হাতে তার কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, তুমি চুপ কর। আমি আর শুনতে চাই না।
কিরি থেমে গেল। তার মুখে হঠাৎ এক ধরনের বিষাদের ছায়া পড়ে। প্রায় শোনা যায়
এ রকম স্বরে বলল, রবোটকে আসলে রবোটের মতোই তৈরি করতে হয়। রবোর্টকে মানুষের মতো তৈরি করা খুব বড় ভুল। তাহলে রবোর্টকে মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু মানুষ তবুও কখনো রবোটকে বুঝতে পারে না। কখনো না।
লাইনা হিংস্র গলায় বলল, দুঃখ-কষ্ট? যন্ত্রণা? কপোট্রনে ভোল্টেজের অসামঞ্জস্য আর দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা এক জিনিস নয়। তুমি মানুষের অনুভূতির কথা এনো না কিরি। মানুষের অনুভূতির কথা বলে তুমি মানুষকে অপমান কোরো না।
আমি দশম প্রজাতির বোট। আমি মানুষের এত কাছাকাছি যে–
মানুষের কাছাকাছি? লাইনার মুখ বিদ্রুপে বিকৃত হয়ে যায়, বাচ্চা একটা ছেলে তোমার মুখের প্রথম কথাটি শুনে বুঝে ফেলেছে তুমি রবোট, আর তুমি দাবি কর তুমি মানুষের কাছাকাছি? লজ্জা করে না কথাটি মুখে আনতে?
কিরির মুখ অপমানে লাল হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি আমাকে ঘৃণা কর লাইনা?
না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি না। তুমি মানুষ হলে করতাম। কিন্তু একটা যন্ত্রকে ঘৃণা। করা যায় না।
তুমি—তুমি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ?
না–যন্ত্রকে অপমান করা যায় না।
কিরির চেহারা হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে শান্ত করে বলল, লাইনা, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। যাবার আগে শুধু একটি জিনিস শুনে যাও। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি একটা যন্ত্র। পৃথিবীর মানুষের জন্যে এই বসতি তৈরি করায় আমার কোনো স্বার্থ নেই। আমাকে তুমি ঘৃণা করবে, আমি জানি শুধু তুমি নও, এই মহাকাশযানের প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে ঘৃণা করবে। কিন্তু এই গ্রহে মানুষের বসতি যদি গড়ে ওঠে সেটি সম্ভব হবে আমার জন্যে। কারণ আমি আবেগকে পাশে সরিয়ে একটি প্রাণীকে হত্যা করে তার কাছ থেকে অমূল্য তথ্য বের করব। সেই প্রাণীটি তোমাদের কাছে মানুষ মনে হলেও সে আসলে মানুষ নয়। মূল তথ্যকেন্দ্রে যার সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই সে পৃথিবীর মানুষ নয়, পৃথিবীর তার জন্যে কোনো দায়িত্ব নেই। এই সহজ এবং আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুর একটি সত্যকে তোমরা গ্রহণ করতে পার না বলে তোমাদের এই মহাকাশযানের দলপতি করা হয় নি। এই মহাকাশযানের দলপতি করা হয়েছে আমাকে—
লাইনা বাধা দিয়ে শ্লেষের সাথে বলল, মহাকাশযানের দলপতি মহামান্য কিরি—
কিরি লাইনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। লাইনা চাপা স্বরে বলল, সম্মানিত দলপতি, আমি কি যেতে পারি?
কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যেতে পার।
লাইনা ঝড়ের মতো ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
০২.
লাইনা মাথা নিচু করে মহাকাশযানের করিডোর ধরে হাঁটছে। দুই চোখ অশ্রুরুদ্ধ, ভয়ঙ্কর এক ধরনের আক্রোশে তার সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। করিডোরের শেষ মাথায় তার ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপের সাথে দেখা হল। লাইনাকে থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, লাইনা, তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। বল আমাকে।
গ্রুসো। মহাকাশযানের দলপতির ক্ষমতা কতটুকু?
গ্রুসো অবাক হয়ে বলল, তুমি এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?
আমি জানতে চাই। কতটুকু?
অনেক।
সে কি মানুষ হত্যা করতে পারে?
গ্রুসসা চমকে উঠে লাইনার দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না। লাইনা আবার জিজ্ঞেস করল, পারে?
আমি যতদূর জানি, পারে। মহাকাশযানের দলপতির সেই ক্ষমতা আছে। তাকে পরে সে জন্যে জবাবদিহি করতে পারে কিন্তু প্রয়োজনে তার প্রাণদণ্ড দেয়ার অধিকার আছে। কিন্তু লাইনা, তুমি কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছ?
কারণ আছে গ্রুসো।
কী কারণ?
আমি তোমাকে বলতে পারব না গ্রুসো। তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তোমার ভালোর জন্যে বলছি।
লাইনা গ্রুসোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, সে তার হাত ধরে বলল, আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি, লাইনা?
লাইনা গ্রুসোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ম্লানমুখে বলল, না, সো। আমাকে এখন আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না।
লাইনা কোয়ারেন্টাইন ঘরটির সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। একটু আগে সে যখন তাকে এই ঘরে রেখে গিয়েছিল তখন সে ভেবেছিল, সুহান তাদের অতিথি। এখন সে জানে সুহান অতিথি নয়, সুহান তাদের বন্দি।
লাইনা হাতলে হাত দিতেই ঘরের দরজাটি খুলে গেল। সে মহাকাশযানের দ্বিতীয় অধিপতি, তার যে কোনো ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি রয়েছে। লাইনা ভিতরে ঢুকে সুহানকে না দেখে চাপা গলায় ডাকল, সুহান—