সুহান সাথে সাথে লাইনাকে কাছে টেনে আনে, দুই হাতে তার মুখটি স্পর্শ করে তার চোখের দিকে তাকায়। হঠাৎ সে কেমন জানি শিউরে উঠে বলল, মানুষের চোখ! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
কেন সুহান? আশ্চর্য কেন?
আমি জানি না কেন, কিন্তু দেখ কী অপূর্ব! কী গভীর! চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আমি বুঝি হারিয়ে যাব। কী রকম একটা রহস্য।
লাইনা সুহানের তীব্র চোখের দৃষ্টির সামনে হঠাৎ কেমন জানি অসহায় অনুভব করতে থাকে, বুকের মাঝে এক ধরনের আলোড়ন হতে থাকে। কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, সুহান–
বল।
তুমি তোমার নিজের চোখ দেখ নি?
হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু নিজের চোখে তো নিজের কাছে কোনো রহস্য নেই। আমি তো আমাকে জানি। কিন্তু আরেকজনের চোখে রহস্য আছে। আমি তোমাকে আগে কখনো দেখি নি। কিন্তু তোমার চোখের ভিতরে তাকালে মনে হতে থাকে আমি বুঝি তোমাকে কত কাল থেকে চিনি। মনে হয়, তোমার ভিতরে কত বিস্ময়।
সুহান কথা থামিয়ে প্রায় হতবাক হয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে থাকে।
লাইনা বিব্রত হয়ে বলল, সুহান—
আমার আমার ইচ্ছে করছে—
কী?
আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে চেপে ধরি।
লাইনা একটু কেঁপে উঠল। সুহান আবার কাতর গলায় বলল, লাইনা, তোমাকে আরেকটু দেখি?
লাইনা কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে সুহানের দিকে তাকাল। সুহান ঠিক কী বলতে চাইছে সে বুঝতে পারল না, তবু অনিশ্চিতের মতো বলল, দেখ।
সুহান ধীরে ধীরে তার হাত তুলে লাইনার মুখে, কপালে, গালে স্পর্শ করে। ঠোঁটে হাত বুলিয়ে তার চুলের মাঝে আঙুল প্রবেশ করিয়ে খুব সাবধানে চুলগুলো দেখে। তারপর লাইনা কিছু বোঝার আগে তাকে অনাবৃত করতে শুরু করে। লাইনা সুহানকে বাধা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল। সুহান অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে কোনো কামনা নেই। শুধু কৌতূহল।
লাইনা তাকে বাধা দিল না।
০৪. মানুষ ও অমানুষ
লাইনা সুহানকে কোয়ারেন্টাইন ঘরে রেখে কিরির কাছে এসেছে। কিরি তার সামনের স্ক্রিনটি সুইচ টিপে বন্ধ করে শান্ত গলায় বলল, ছেলেটি এখন কী করছে লাইনা?
কিছু করছে না। মিডি রবোট তাকে পরীক্ষা করে দেখছে। একটু রক্ত নেবে, টিস্য নেবে, পরীক্ষা করে দেখবে।
ও।
কী আশ্চর্য একটা ব্যাপার কিরি! তুমি চিন্তা করতে পার একজন সত্যিকার মানুষ থাকে এই গ্রহে!
হ্যাঁ।
তার মহাকাশযান যখন বিধ্বস্ত হয়েছিল তখন তাকে মায়ের গর্ভ থেকে ট্রিনি—
জানি।
লাইনা একটু অবাক হয়ে বলল, কেমন করে জান?
আমি এখানে বসে তোমাদের দেখছিলাম।
লাইনা চমকে কিরির দিকে তাকাল। হঠাৎ অনুভব করে তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। কোনোরকমে নিজেকে সংযত করে বলল, এই ছেলেটি একা একা ষোলো বছর এই গ্রহে কাটিয়েছে। তুমি চিন্তা করতে পার?
কিরি কেমন জানি রুক্ষ গলায় বলল, পারি। তোমরা যখন শীতলঘরে ঘুমিয়েছিলে তখন পঞ্চাশ বছর আমি একা একা ছিলাম।
কিন্তু—
কিন্তু কী?
প্রথমত, তুমি সত্যিকার অর্থে একা ছিলে না। তুমি জানতে এই মহাকাশযানে আরো অনেক মানুষ আছে। দ্বিতীয়ত–
দ্বিতীয়ত?
দ্বিতীয়ত, তুমি মানুষের মতো কিন্তু নও। তোমাকে এ ধরনের পরিস্থিতির জন্যে তৈরি করা হয়েছে।
কিরি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছেলেটা যে এখানে আছে সেটা কতজন জানে?
আমি আর তুমি।
চমৎকার। আমি চাই সেটা যেন আর কেউ না জানে।
লাইনা জিজ্ঞাসু চোখে বলল, কেন?
ছেলেটা আমাদের জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্য বয়ে এনেছে লাইনা। তাকে আমাদের দরকার।
কিরি ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে পারল না। লাইনা অনিশ্চিতের মতো বলল, হ্যাঁ। সুহানেরও আমাদের দরকার। মানুষের সঙ্গ পাবার জন্যে সে একেবারে খ্যাপার মতো হয়ে আছে।
কিরি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক কী বলছি তুমি বুঝতে পার নি লাইনা।
হঠাৎ করে লাইনার বুক কেঁপে ওঠে। কিরির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ কিরি?
আমি বলতে চাইছি ছেলেটাকে আমাদের দরকার। তার শরীরটাকে।
মানে?
আমরা এই গ্রহে বসতি স্থাপন করতে এসেছি। আমাদের কাছে রয়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষের জ্বণ। তারা এই গ্রহে বাঁচতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করবে কিছু তথ্যের ওপর। এই ছেলেটা না হলে সেই তথ্য বের করতে আমাদের এক যুগ লেগে যেত। এখানে আর আমাদের এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে না। ছেলেটার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে কয়েক ঘণ্টার মাঝে সব তথ্য পেয়ে যাব।
তুমি—তুমি বলছ দেহ ব্যবচ্ছেদ করে?
হ্যাঁ। তার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ মূল্যবান লাইনা। তার প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মূল্যবান।
লাইনার হঠাৎ কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে। পিছনে সরে এসে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি সুহানকে মেরে ফেলার কথা বলছ?
হ্যাঁ, লাইনা।
লাইনা বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরির ভাবলেশহীন মুখ, স্থির চোখ দেখে হঠাৎ তার মনে হতে থাকে সে বুঝি একটি দানবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটি অমানুষ পিশাচের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি তাকে মেরে ফেলার কথা বলছ না?
কিরি তার প্রত্যেকটা শব্দে জোর দিয়ে বলল, আমি তাকে সত্যি মেরে ফেলার কথা বলছি লাইনা।
কিন্তু সে একজন মানুষ।
কিরি একটু অবাক হয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, জৈবিক হিসেবে সে মানুষ হতে পারে কিন্তু সত্যিকার অর্থে সে তো মানুষ নয়। পৃথিবীর কোনো তথ্যকেন্দ্রে তার নাম নেই, এই গ্রহের একটি বন্যপ্রাণীর সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই।