সুহান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় ভিতরে চোখ ধাঁধানো আলো। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ লাগল তার অভ্যস্ত হতে। যখন হাত সরিয়ে চারদিকে তাকাল, দেখল একটা গোলাকার ঘরে সে কোঁ। ঘরের চারপাশে অনেক রকম যন্ত্রপাতি। উপরে একটি মনিটর। কিছু বাতি জ্বলছে এবং নিভছে, কোথা থেকে জানি তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আসছে।
আমাকে স্ক্যান করছে, সুহান নিজেকে বোঝাল, আমাকে স্ক্যান করে দেখছে আমার শরীরে কোনো রোগজীবাণু আছে কি না। আমি জানি, নেই। এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ হয়েছে অন্যভাবে।
সুহান চারদিকে তাকাল। নিশ্চয়ই মানুষেরা এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। পৃথিবীর মানুষের ভাষা তো একটিই। তার সাথে কথা বলতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়।
হঠাৎ করে সামনের স্বচ্ছ দরজাটি খুলে গেল। সুহানের বুকে রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। উত্তেজনায় তার বুক ধকধক করতে থাকে। তাহলে কি সে সত্যিই দেখবে একজন মানুষ? পৃথিবীর মানুষ? সত্যিকারের মানুষ? সুহান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখে ঠিক একজন খোলা দরজা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। দীর্ঘ দেহ, উজ্জ্বল চোখ, কপালের দুপাশে রুপালি রঙের ছোঁয়া। সুহান হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কখনো কি সে কল্পনা করেছিল একজন মানুষকে সে সত্যি দেখতে পাবে?
মানুষের সাথে প্রথম দেখা হলে কী বলরে সব ঠিক করে রাখা আছে। সুহান মনে মনে সম্ভাষণটি কয়েকবার বলে একটু এগিয়ে যায়, তখন মানুষটি কোমল গলায় বলল, আমি কিরি। এই মহাকাশযানের দলপতি।
সুহান অবাক হয়ে কিরির দিকে তাকাল, তার কথা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় নি। ঠিক তার ভাষাতেই কথা বলেছে, কিন্তু লোকটির কথায় কিছু একটা রয়েছে যেটাকে হঠাৎ করে খুব পরিচিত মনে হয়, সেটা কী সে ধরতে পারল না। কিরি একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
সুহান মাথা নাড়ল, একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ তার মাথায় উঁকি দিতে থাকে।
আমি তোমাকে আমাদের মহাকাশযানের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সুহান বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে। কিরি মানুষ নয়। কিরি একজন রবোট। সে কেমন করে বুঝতে পেরেছে জানে না কিন্তু তার কোনো সন্দেহ নেই। খুব বড় ধাক্কা খেল সুহান, তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল কিরির দিকে, তারপর প্রায় ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি রবোট। এখানে মানুষ নেই? আমি মানুষের সাথে কথা বলতে চাই।
কিরির মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় সাথে সাথে। কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান আমি রবোট?
আমি জানি। সুহান প্রায় চিৎকার করে বলল, তোমাদের এখানে মানুষ নেই? মানুষ?
সুহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কিরি আহত গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে আমি রবোট? আমি দশম প্রজাতির রবোট আমার সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। আশ্চর্য!
আমি সারা জীবন রবোটের সাথে থেকেছি, বর্বোট দেখলেই আমি বুঝতে পারি।
কেমন করে?
আমি জানি না, কিন্তু আমি বুঝতে পারি।
তোমার নাম কী ছেলে? তুমি কি একা এখানে?
হ্যাঁ, আমি একা। আমার সত্যিকার নাম আমি জানি না, ট্ৰিনি আমাকে সুহান ডাকে।
ট্রিনি?
হ্যাঁ, ট্রিনি। একজন রবোট, সে আমাকে বড় করেছে।
ও।
সুহান আবার একটু অস্থির হয়ে কিরির দিকে তাকাল। বলল, কোনো মানুষ নেই এখানে? মানুষ?
আছে। কিরি অন্যমনকের মতো বলল, আছে।
আমি একজন মানুষ দেখতে চাই।
দেখবে। অবশ্যি দেখবে। এস আমার সাথে।
সুহান জীবনের প্রথম যে মানুষটি দেখল সে লাইনা। আলোকোজ্জ্বল একটি ঘরের মাঝখানে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চারপাশে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, সেগুলো নিয়ে সুহানের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।
লাইনা একটা দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকল। ঘরের মাঝখানে সুহানকে দেখে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। একজন মানুষের দেহে এত রূপ থাকতে পারে এবং সেই মানুষটি সেই রূপ সম্পর্কে এত উদাসীন থাকতে পারে সে কখনো কল্পনা করে নি। এই অসম্ভব রূপবান মানুষটি একা একা এই নির্জন গ্রহে বড় হয়েছে, মানুষের ভালবাসা দূরে থাকুক, তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত অনুভব করে নি, এই প্রথমবার সে একজন মানুষকে দেখেছে, চিন্তা করে হঠাৎ লাইনার বুকের মাঝে জানি কেমন করে ওঠে। কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যায়। সুহানের কাছাকাছি গিয়ে নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই সুহান। আমি লাইনা।
মানুষের সাথে দেখা হলে কী করতে হয় সেটি সুহান থেকে ভালো করে সম্ভবত কেউ জানে না। অসংখ্যবার ব্যাপারটি সে কল্পনা করেছে কিন্তু লাইনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে তার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। সুহান জানে, একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষের দিকে তার হাত এগিয়ে দেয়, সেই হাত স্পর্শ করে ছেড়ে দিতে হয় কিন্তু সে লাইনার হাত ছেড়ে দিল না। দুই হাতে সেটিকে ধরে রেখে অনেকটা বিভ্রান্তের মতো লাইনাকে নিজের কাছে টেনে আনল। লাইনার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে হঠাৎ প্রায় আর্তস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, তুমি মেয়ে!
লাইনা হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি মেয়ে।
সুহান ফিসফিস করে বলল, আমি ছেলে।
আমি জানি।
আমি কখনো মেয়ে দেখি নি।
আমি তাই ভাবছিলাম। তুমি আগে কখনো অন্য মানুষ দেখ নি।
আমি তোমাকে দেখি?
লাইনা একটু অবাক হয়ে বলল, দেখ।