বল সুহান।
আমার—আমার চুল কি খুব বেশি বড়?
না সুহান। মানুষের চুল এ রকম বড় হয়।
পোশাক? আমার পোশাক?
সুহান, তোমার পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
কিন্তু আমার পুরো শরীর ঢেকে যেতে হবে না?
আমি তোমাকে এক টুকরা নিও পলিমার বের করে দেব।
তারা কি আমার ভাষায় কথা বলবে?
নিশ্চয়ই তারা তোমার ভাষায় কথা বলবে। পৃথিবীতে মানুষের একটি ভাষা। আমি তোমাকে সেই ভাষা শিখিয়েছি সুহান।
আমাকে দেখে পৃথিবীর মানুষ কী করবে ট্রিনি?
আমি নিশ্চিত; তারা হতবাক হয়ে যাবে। যখন জানবে তুমি একা একা এই গ্রহে বড় হয়েছ, তারা তোমাকে বুকে টেনে নেবে।
তুমি নিশ্চিত ট্রিনি?
আমি নিশ্চিত।
সুহান অনিশ্চিতের মতো ক্রোমিয়ামের স্বচ্ছ দেয়ালে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তার মতো মানুষের সাথে দেখা হবে তার? সত্যি দেখা হবে?
০৩.
কিরি এবং লাইনা মহাকাশযানের ছোট ল্যাবরেটরিতে বসে আছে। ছোট একটা স্কাউটশিপ বাইরে থেকে কিছু পাথরের নমুনা এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে বাতাস নিয়ে এসেছে। নমুনাগুলো পরীক্ষা করে পৃথিবীর সাথে তুলনা করে সেগুলো একটি মনিটরে দেখানো হচ্ছিল। তুলনাটুকু বিস্ময়কর। জলীয় বাষ্পের অভাবটুকু ছাড়া হঠাৎ দেখে এটিকে পৃথিবী বলে ভুল করা সম্ভব। তাদের সামনে যে তথ্য রয়েছে সেটা দেখে মনে হয় পৃথিবীর মানুষ কোনোরকম পোশাক ছাড়াই এই গ্রহে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারবে। আশ্চর্য, এই তথ্যটুকু যখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে দেখছিল তখন মাথার কাছে স্ক্রিনে মহাকাশযানের নিরাপত্তা রবোটের ধাতব কণ্ঠস্বর শোনা গেল, মহামান্য কিরি, মহাকাশযানের বাইরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
কিরি অবাক হয়ে বলল, কী বললে?
একজন মানুষ।
কিরি লাইনার দিকে তাকাল, তারপর অবাক হয়ে স্ক্রিনে নিরাপত্তা রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, একজন মানুষ?
হ্যাঁ মহামান্য কিরি, একজন মানুষ। মনে হয় সে মহাকাশযানের ভিতরে আসতে চাইছে।
লাইনা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল, কোথায়? কোথায় মানুষ?
আমি স্ক্রিনে দেখাচ্ছি মহামান্য কিরি এবং মহামান্যা লাইনা।
হঠাৎ করে দেয়ালের বিশাল স্ক্রিনে একজন অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরের মুখ ভেসে ওঠে। ঝড়ো বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার পোশাক উড়ছে। উত্তপ্ত ধুলায় ধূসর হয়ে আছে তার মুখ, তার লম্বা কালো চুল। হাত দিয়ে মুখ থেকে লম্বা চুল সরিয়ে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহাকাশযানের দিকে। কালো চোখে এক আশ্চর্য মুগ্ধ বিস্ময়।
লাইনা কাঁপা গলায় বলল, মানুষ! একজন সত্যিকারের মানুষ।
হ্যাঁ।
কোথা থেকে এল?
নিশ্চয়ই বিধ্বস্ত মহাকাশযান থেকে। নিশ্চয়ই কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিল।
আর কেউ কি আছে?
মনে হয় না। থাকলে এই কিশোরটি একা এখানে আসত না।
তুমি বলছ এই কিশোরটি একা একা এই গ্রহে আছে?
আমি জানি না কিন্তু আমার তাই মনে হয়।
লাইনা উত্তেজিত হয়ে বলল, ওকে ভিতরে আসতে দাও। একা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে!
কিরি মুখ ঘুরিয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানের নীতিমালায় জীবন্ত প্রাণী নিয়ে অনেক রকম বাধানিষেধ আছে।
জীবন্ত প্রাণী? লাইনা চিৎকার করে বলল, এটি জীবন্ত প্রাণী নয় কিরি—এটি একজন মানুষ। সত্যিকারের মানুষ।
কিরি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, একজন মানুষ।
এক্ষুনি দরজা খুলে ওকে ভিতরে আসতে দাও।
কিরি লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, লাইনা, তুমি একটু শান্ত হও। আমি ওকে ভিতরে আনছি।
কিরি প্রতিরক্ষা রবোটকে বলল, কিউ-৪৬, তুমি এই মানুষটকে ভিতরে আসতে দাও। দুই নম্বর চ্যানেল দিয়ে কোয়ারেন্টাইন ঘরে। ওর শরীর স্ক্যান শুরু কর, রোগজীবাণু ভাইরাস কিছু থাকলে রিপোর্ট কর কিন্তু তাকে সেটা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা কোরো না। হয়তো এই গ্রহে থাকার জন্যে তার কিছু একটা মাইক্রোব দরকার আমরা যেটা জানি না।
ঠিক আছে মহামান্য কিরি।
সাথে সাথে লাইনা ল্যাবরেটরি ঘরের দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছিল, কিরি তাকে থামাল। জিজ্ঞেস করল, লাইনা—
কী হল?
কোথায় যাও?
ছেলেটার সাথে দেখা করতে।
একটু দাঁড়াও লাইনা। তাকে কোয়ারেন্টাইন ঘরে আসতে দাও। প্রাথমিক একটা পরীক্ষা শেষ করে নিতে দাও।
কিন্তু–
হ্যাঁ, আরেকটা কথা লাইনা। ছেলেটার কথা এখন যেন জানাজানি না হয়। শুধু তুমি আর আমি।
কেন?
কারণ আছে লাইনা। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি। ব্যাপারটা আমাদের ঠিক করে সামলে নিতে হবে। বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠো না!
লাইনা আবার মাথা ঝাকিয়ে বলল, কিন্তু একজন মানুষ!
আমি জানি লাইনা! আমাকে আগে তার সাথে দেখা করতে দাও। আমাকে আগে তার সাথে কথা বলতে দাও। তার কোনো ভাষা আছে কি না আমরা জানি না, যদি না থাকে, আমি তবুও তার সাথে ভাব বিনিময় করতে পারব। তুমি পারবে না।
০৪.
সুহান দীর্ঘ সময় মহাকাশযানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মহাকাশযানটি ঠিক তার মহাকাশযানের মতো। সে জানে কোনটি ভিতরে প্রবেশ করার দরজা। সে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে জানে কোথায় ক্যামেরাগুলো আছে, সে দাঁড়িয়েছে যেন ঠিক করে তাকে দেখতে পায়। সে তার চুল পাট করে এসেছিল, বড় একটা নিও পলিমার কাপড় সারা দেহে জড়িয়ে। ঝড়ো বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে, এখন তার পোশাক উড়ছে। মনে হয় সে নিজেও বুঝি উড়ে যাবে। যখন মনে হল সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, তখন হঠাৎ করে উপরের গোল দরজাটা খুলে গেল। সেখান থেকে প্রথমে একটা রবোটের মাথা উঁকি দিল এবং এক মুহূর্ত পরে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে আসে।