০২.
সুহান মহাকাশযানের জানালায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে ভয়ঙ্কর ঝড়ো বাতাস। প্রথম সূর্য অস্ত গিয়েছে। দ্বিতীয় সূর্যটি মোটেও প্রখর নয়, চারদিকে কেমন এক ধরনের লালাভ আলো। বছরের এই সময়টাতে হঠাৎ করে এই গ্রহের আবহাওয়া খুব খাপছাড়া হয়ে ওঠে। ভয়ঙ্কর ঝড় হয়, উত্তপ্ত লাল বালু বাতাসে উড়তে থাকে। পাথর ভেঙে ভেঙে পড়ে, বাতাসে হু-হু করে বিচিত্র শব্দ হয় তখন। কেমন এক ধরনের মন খারাপ করা শব্দ। সুহান তখন মহাকাশযান থেকে বেশি বাইরে যায় না। চার দেয়ালের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বসে তার ছোট ছোট যন্ত্রগুলো দাঁড়া করায়। যন্ত্রগুলো সহজ এবং বিচিত্র। মূল তথ্যকেন্দ্রের কোনো তথ্য ব্যবহার না করে তৈরী। ট্রিনি এই যন্ত্রগুলো দেখে একই সাথে বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়, তার কপোট্রনের সহজ যুক্তিতর্কে দুটোর মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই। বিরক্তির কারণটুকু সহজ। এই ধরনের ছেলেমানুষি যন্ত্রের কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। ট্রিনির ধারণা, এগুলো তৈরি করা অহেতুক সময় নষ্ট করা। বিস্ময়টুকু অবশ্যি খাটি। মূল তথ্যকেন্দ্রের কোনো তথ্য ব্যবহার না করে এই যন্ত্রগুলো তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। যে পরিমাণ খুঁটিনাটি এবং মৌলিক জ্ঞানের প্রয়োজন, এই শতাব্দীতে মনে হয় কোনো মানুষ একসাথে সেই জ্ঞান অর্জন করে নি। চেষ্টা করলে সম্ভব নয় সেটি সত্যি নয়, কিন্তু চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে কেউ চেষ্টা করে নি। ট্রিনির মতে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন জ্ঞান।
সুহান জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের ঝড়ো হাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তপ্ত বালুরাশি শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক আগে বাই ভার্বালে করে ট্রিনি পাহাড়ের দিকে উড়ে গেছে। এই রকম দুর্যোগের মাঝে ট্রিনির মতো একটি রবোটের বাইরে কী কাজ থাকতে পারে কে জানে। সুহান ব্যাপারটি নিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে হাল ছেড়ে দেয়। হয়তো আবহাওয়ায় কোনো বড় পরিবর্তন আসছে, সে তার খোজ নিতে যাচ্ছে, গত ঝড়ে যেরকম হয়েছিল। কিংবা কে জানে হয়তো বিচিত্র কোনো নিশাচর প্রাণী এসেছে, গত বছর যেরকম এসেছিল। কিংবা কে জানে হয়তো পানির একটা বড় হ্রদ খুঁজে পেয়েছে, যেটা তারা অনেকদিন থেকে খুঁজছে।
সুহান মেঝেতে রাখা তার জেনারেটরটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মহাকাশযানের বেশ কয়েকটি জেনারেটর আছে। তার মাঝে একটির বেশ কিছু অংশ খুলে সে তার নিজের মতো করে একটি জেনারেটর তৈরি করেছে। বিশাল তারের কুণ্ডলী একটা শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের মাঝে ঘুরছে। জেনারেটরটি ঘোরানো নিয়ে সমস্যা, যখন এ রকম ঝড়ো হাওয়া আসে সে জানালায় একটা টারবাইন লাগিয়ে জানালাটি খুলে দেয়। আজও দিয়েছে। ঝড়ো হাওয়ায় টারবাইনটি ঘুরছে, সেটি ঘোরাচ্ছে জেনারেটরটি, সেখান থেকে মোটামুটি একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ হচ্ছে। সুহান মেপে দেখল, ইচ্ছে করলে সে সত্যিকারের কিছু শক্তিশালী ব্যাটারি বিদ্যুতায়িত করে ফেলতে পারে। আপাতত তার সেরকম কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করার ইচ্ছা নেই। একটা টেসলা কয়েল জুড়ে দিয়েছে, সেখান থেকে শব্দ করে নীলাভ বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে উত্তপ্ত বালু এসে ঘরের মাঝে একটা ঘূর্ণি তৈরি করেছে, সুহান তার মাঝে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকে।
দরজা খুলে যখন ট্ৰিনি ঘরে ঢুকেছে তখন বাতাসের ঘূর্ণিতে ঘরের জিনিসপত্র উড়ছে। বাতাসের প্রচণ্ড গজন ঘরের মাঝে গুমরে উঠছে। লাল বালুতে ঘর অন্ধকার, সুহানের সমস্ত শরীর, মাথার চুল, চোখের ভুরু পর্যন্ত ধুলায় ধূসর। ট্রিনিকে দেখে সুহান একটু লজ্জা পেয়ে যায়। জানালাটা ঠেলে বন্ধ করে দিতেই হঠাৎ ঘরের ভিতরে এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। সুহান ঘরের চারদিকে তাকিয়ে একটা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ট্রিনি, তুমি যদি একটু আগে আসতে তাহলে একটা অপূর্ব জিনিস দেখতে পেতে। টারবাইনের গিয়ারে বালু জমা হয়ে গিয়ারটা বন্ধ হয়ে গেল, না হয়—
সুহান।
চমৎকার বিদ্যুৎপ্রবাহ হয়। ইচ্ছে করলে ব্যাটারির সাথে—
সুহান—
কী হল?
সুহান, তুমি একটু স্থির হয়ে বস।
কেন ট্রিনি?
আমি তোমাকে খুব একটা জরুরি জিনিস বলব।
সুহান হঠাৎ একটু ভয় পেয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলল, কী হয়েছে ট্রিনি, তুমি কী বলবে?
জিনিসটি বলার আগে আমি নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে গিয়েছিলাম।
কী জিনিস ট্রিনি?
আমাদের এই গ্রহে একটা মহাকাশযান নেমেছে সুহান। পৃথিবীর মহাকাশযান।
সুহান হতবাক হয়ে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে ঠিক বুঝতে পারছে না ট্রিনি কী বলছে।
ট্রিনি দুই হাতে সুহানকে শক্ত করে ধরে শান্ত গলায় বলল, সুহান, আমরা এই দিনটির জন্যে গত মোলো বছর থেকে অপেক্ষা করছি। আজকে সেই দিনটি এসেছে। পৃথিবীর মানুষ এসেছে এই গ্রহে। তারা তোমাকে বুকে করে আগলে নেবে সুহান।
সুহান তখনো বিস্ফারিত চোখে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে আছে। ফিসফিস করে বলল, মানুষ?
হ্যাঁ সুহান।
সত্যিকারের মানুষ?
হ্যাঁ।
আমার মতো মানুষ? আমার মতো?
হ্যাঁ সুহান। তোমার মতো।
তুমি নিজের চোখে দেখেছ? নিজের চোখে?
হ্যাঁ সুহান, আমি নিজের চোখে দেখেছি।
সুহান কেমন একটা ঘোরের মাঝে ক্রোমিয়াম দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে ধুলা পরিষ্কার করতেই ঝকঝকে আয়নার মতো স্বচ্ছ দেয়ালে তার প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে। সুহান অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। কতকাল সে নিজেকে দেখে নি! তাকে দেখে কী কর, মানুষ? সে কাঁপা গলায় বলল, ট্রিনি।