- বইয়ের নামঃ নিঃসঙ্গ গ্রহচারী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. একাকী কিশোর
সুহান হাতের উপর মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশের রং নীলাভ কিন্তু নীল নয়। স্বচ্ছ কাচের মতো। পৃথিবীর আকাশ নাকি নীল। গাঢ় নীল। সে কখনো পৃথিবী দেখে নি কিন্তু তবু সে জানে। তাকে ট্ৰিনি বলেছে। ট্ৰিনি তাকে আরো অনেক কিছু বলেছে। পৃথিবীর নীল আকাশে নাকি সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। কখনো কখনো সেই মেঘ নাকি পুঞ্জীভূত হয়ে আসে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যায়, তারপর নাকি আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি জন্ম দেয় গাছ। ট্ৰিনি বলেছে, পৃথিবীর গাছ নাকি সবুজ। গাঢ় সবুজ। সেই গাছে নাকি ফুল হয়। বিচিত্র রঙিন সব ফুল। ট্ৰিনি সব জানে। ট্রিনিকে পৃথিবীতে তৈরি করা হয়েছিল, তার কপোট্রনের ক্রিস্টাল ডিস্কে পৃথিবীর সব খবর রাখা আছে। ট্ৰিনি একটু একটু করে সুহানকে সব বলেছে। সুহান জানতে চায় না, তবু সে বলেছে। সুহানকে নাকি জানতে হবে। সুহান মানুষ। মানুষের জন্মগ্রহ পৃথিবী। তাই সব মানুষকে নাকি পথবীর কথা জানতে হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর কথা ভাবতে হয়।
সুহান তাই পাথরের উপর শুয়ে শুয়ে কখনো কখনো পৃথিবীর কথা ভাবে। ভাবতে চায় না, তবু সে ভাবে। ট্ৰিনি বলেছে, তাকে ভাবতে হবে। পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে, মানুষের কথা ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে তাকে সত্যিকার মানুষের মতো হতে হবে। যদি কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হয় তারা যেন সুহানকে দেখে চমকে না ওঠে। ভয় পেয়ে চিৎকার না করে ওঠে।
সুহান এক সময় ট্রিনির কথা বিশ্বাস করত। ভাবত, সত্যিই বুঝি তার একদিন মানুষের সাথে দেখা হবে। দেখা হলে কী বলবে সব ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু তার মানুষের সাথে দেখা হয় নি। সে জানে কোনোদিন মানুষের সাথে তার দেখা হবে না। স্বচ্ছ কাচের মতো নীলাভ আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একদিন তার জীবন শেষ হয়ে যাবে। দুই সূর্যের এই গ্রহটিতে কোনোদিন মানুষ ফিরে আসবে না। কখনো আসবে না।
সুহান পাশ ফিরে শোয়। তার দেহের রং উজ্জ্বল স্বর্ণের মতো। তার মাথায় কুচকুচে কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। তার শরীর সুঠাম, পেশিবহুল। তার বিস্তৃত বক্ষ, দীর্ঘ দেহ। তার দীর্ঘ চোখ, চোখের রং রাতের আকাশের মতো কালো। ট্ৰিনি বলে, তার চেহারা নাকি অপূর্ব সুন্দর। সুহান সেটা জানে না। মহাকাশের এক প্রান্তে নির্জন গ্রহের একটি একাকী কিশোরের কাছে সৌন্দর্যের কোনো অর্থ নেই।
সুহান প্রায় নগ্ন দেহে পাথরের উপর শুয়ে আছে। তার দেহ অনাবৃত, শুধু ছোট এক টুকরো নিও পলিমারের কাপড় তার কোমর থেকে ঝুলছে। এই গ্রহে সুহান ছাড়া আর কোনো মানুষই নেই। তার নগ্নতা ঢেকে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু সে ঢেকে রাখে। ট্রিনি বলেছে, মানুষ হলে নগ্নতা ঢেকে রাখতে হয়। ট্রিনির কথা সে বিশ্বাস করে না, তার সাথে সে অবিরাম তর্ক করে। কিন্তু তর্ক করেও সে ট্রিনির কথা শোনে। এই গ্রহে ট্ৰিনি ছাড়া তার কথা বলার আর কেউ নেই।
সুহান শুয়ে শুয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। বহুদূরে নীল পাহাড়ের সারি। ওই পাহাড়গুলোর কোনো কোনোটা আগ্নেয়গিরি। সময় সময় ভয়ঙ্কর গর্জন করে অগ্ন্যুৎপাত হয়। মাটি থরথর করে কাঁপে, আকাশ কালো হয়ে যায় বিষাক্ত ধোয়ায়, গলিত লাভা বের হয়ে আসে ক্রুদ্ধ নিশাচর প্রাণীদের মতো। এখন পাহাড়গুলো স্থির হয়ে আছে। ট্ৰিনি বলেছে, পৃথিবীর পাহাড় হলে ওই পাহাড়ের চূড়ায় শুভ্র তুষার থাকত। এটা পৃথিবী নয়, তাই দূর পাহাড়ের চূড়ায় কোনো শুভ্র তুষার নেই। এই গ্রহটি পৃথিবীর মতো নয় কিন্তু এটাই সুহানের পৃথিবী, সুহানের গ্রহ। তার নিজের গ্রহ। যে গ্রহে ট্ৰিনি তাকে বুকে আগলে বড় করেছে। সুহান দীর্ঘ সময় দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে এক সময় ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করল। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ তার বুকের মাঝে বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। সে এই অনুভূতির অর্থ জানে না। কাউকে সে এই অনুভূতির কথা বলতে পারবে না। ট্ৰিনি অনুভূতির অর্থ জানে না। ট্ৰিনি একটি রবোট। দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। তার কপোট্রনে অসংখ্য তথ্য কিন্তু বুকে কোনো অনুভূতি নেই।
সুহান।
সুহান চোখ খুলে তাকাল। তার পায়ের কাছে ট্রিনি দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ ধাতব দেহ। সবুজাভ ফটোসেলের চোখ। ভাবলেশহীন যান্ত্রিমুখ।
কী হল ট্রিনি?
তুমি অনেকক্ষণ থেকে শুয়ে আছ সুহান।
হ্যাঁ ট্রিনি।
ওঠ। প্রথম সূর্য ডুবে গেছে। একটু পরেই দ্বিতীয় সূর্য ডুবে যাবে।
যাক।
খুব অন্ধকার হবে আজ।
হোক।
সব নিশাচর প্রাণী বের হবে সহান।
হোক। আমি কোনো নিশাচর প্রাণীকে ভয় পাই না ট্রিনি।
এ রকম বলে না সুহান। নিশাচর প্রাণীকে ভয় পেতে হয়। অর্থহীন দম্ভ ভালো নয়।
কেন ভালো নয়।
দাম্ভিক মানুষকে কেউ পছন্দ করে না সুহান।
সুহান বিষণ্ণ গলায় মাথা নেড়ে বলল, এখানে আর কেউ নেই ট্ৰিনি। আমাকে পছন্দ করারও কেউ নেই। অপছন্দ করারও কেউ নেই।
কিন্তু কেউ যদি আসে?
সুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেউ আসবে না।
কেন আসবে না? আমরা তো এসেছিলাম। তোমার মা এসেছিল। তোমার মায়ের গর্ভে করে তুমি এসেছিলে। একটি মহাকাশযান ভরা মানুষ এসেছিল।