নীরা ত্রাতিনা জানলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যেত, তার ক্লোনের সংখ্যা কাকতালীয়ভাবে ছিল ঠিক উনিশ জন।
.
মনিটরটি স্পর্শ করতেই প্রায় নিঃশব্দে চিঠিটি স্বচ্ছ পলিমারে ছাপা হয়ে বের হয়ে এল। উপরে বিজ্ঞান কেন্দ্রের লোগো, বাম পাশে কিছু দুর্বোধ্য সংখ্যা, ডান পাশে মহাপরিচালকের নিশ্চিতকরণ হলোগ্রাম। চিঠির ভাষা ভাবলেশহীন এবং কঠোর–আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পরে বছরের একটি মেয়েকে বিজ্ঞান কেন্দ্রের মূল দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে। কেন পৌঁছে দিতে হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই, কখনো থাকে না। অন্য চিঠিগুলো থেকে এটা একটু অন্যরকম। নিচে লেখা আছে মেয়েটাকে সুস্থ, সবল ও নীরোগ হতে হবে যেন টেলিস শহরের দূর্গম যাত্রাপথের ধকল সহ্য করতে পারে।
চিঠিটার দিকে তাকিয়ে তিশিনা নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করে। পলিমারের একটা পৃষ্ঠায় এই নিরীহ কয়েকটা লাইন একটি মেয়ের জীবনকে কী অবলীলায় সমাপ্ত করে দেবে। চার দেয়ালের ভেতরে আটকে রাখা গোপন ল্যাবরেটরিতে বড় হওয়া এই ক্লোন মেয়েগুলো যদি আর দশটি মেয়ের মতো হত তা হলে কি এই আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় বিজ্ঞান কেন্দ্র তাদের এভাবে ব্যবহার করতে পারত? নিশ্চয়ই পারত না। আর সেটি ভেবেই তিশিনার ভেতরে ক্রোধ পাক খেয়ে উঠতে থাকে। একসময় এখানে উনিশ জন মেয়ে ছিল। একজন একজন করে বিজ্ঞান কেন্দ্র আট জন মেয়ে নিয়ে গেছে। এখন আছে মাত্র এগার জন।
তিশিনা একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, আমি এই কাজের উপযুক্ত নই। ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা ক্লোনকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয় নি, তাদের সঙ্গে নিজের একাত্মবোধ করার কথা নয়। ল্যাবরেটরির গিনিপিগ এবং এই মেয়েগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই মেয়েগুলোর ব্যাপারে তার হওয়ার কথা নির্মোহ এবং পুরোপুরি উদাসীন। কিন্তু তিশিনা খুব ভালো করেই জানে, সেটি সম্ভব নয়। যারা দূরে বসে তথ্যকেন্দ্রের সংখ্যা থেকে এদের হিসাব রাখে তারা নির্মোহ হতে পারে, উদাসীন হতে পারে। কিন্তু তার মতো একজন সুপারভাইজার–যাকে প্রায় প্রতিদিন মেয়েগুলোর সঙ্গে সময় কাটাতে হয়, তারা কেমন করে নির্মোহ হবে? কেমন করে উদাসীন হবে? এরকম হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়েদের। জন্য গভীর মমতা অনুভব না করাটাই তো বিচিত্র। যারা ক্লোনদের নিয়ে এই গোপন প্রোগ্রামটি শুরু করেছিল তারা কি বিষয়টি ভাবে নি?
তিশিনা চিঠিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, একটি মেয়েকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাকে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে। তার এখনই গিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। মেয়েগুলোর সঙ্গে দেখা করে একজনকে বেছে নিতে হবে। কী নিষ্ঠুর একটা কাজ, অথচ তিশিনা জানে কী সহজেই না সে এই কাজটি শেষ করবে!
ক্লোন হোস্টেলের বড় গেটটি ভোলার জন্য তিশিনাকে গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহার প্রতে হল। ভেতরের দুর্ভেদ্য দরজাগুলো খোলার জন্য পাসওয়ার্ড ছাড়াও তার আইরিস স্ক্যান করিয়ে নিতে হল। লম্বা করিডরের অন্যপাশে একটা বড় হলঘর, সেখানে ক্লোন মেয়েগুলো কিছু একটা করছিল, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সবাই ছুটে এল। ফুটফুটে চেহারা, একমাথা কালো চুল, মসৃণ ত্বক, ঠোঁটগুলো যেন অভিমানে কোমল হয়ে আছে। সব মিলিয়ে এগার জন, সবাই হুবহু একই চেহারার। শত চেষ্টা করেও কখনো তাদের আলাদা করা সম্ভব নয়। তিশিনা তাই কখনো চেষ্টা করে না। মেয়েগুলো তিশিনাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরে। একজন হাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করে বলল, ইস! তিশিনা আজকে তোমাকে দেখতে একেবারে স্বর্গের দেবীর মতো সুন্দর লাগছে।
তিশিনা হেসে ফেলল, যৌবনে হয়তো চেহারায় একটু মাধুর্য ছিল, কিন্তু এখন এই মধ্যবয়সে তার কিছু অবশিষ্ট নেই। তার ধূসর চুল, শুষ্ক ত্বক আর ক্লান্ত দেহে এখন আর কোনো সৌন্দর্য নেই। তিশিনা বলল, স্বর্গের দেবীরা তোমাদের কথা শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে, মেয়েরা।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলল, কেন রাগ করবে? আমরা কি মিথ্যে কথা বলছি?
পাশের মেয়েটি বলল, এতটুকু মিথ্যে বলি নি। তুমি যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আস তখন আমাদের কী আনন্দ হয় তুমি জান?
প্রথম মেয়েটি বলল, সেজন্যই তো তোমাকে আমাদের স্বর্গের দেবী বলে মনে হয়।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি মেয়ে আদুরে গলায় বলল, আজকে তোমার। আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকতে হবে।
অন্যরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ।
আমরা আজকে একসঙ্গে খাব তিশিনা। ঠিক আছে?
তিশিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি আসলে এসেছি একটা কাজে।
কাজে?
একসঙ্গে সবগুলো মেয়ের চোখেমুখে বিষাদের একটা ছায়া পড়ে। তাদের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর কাজ মাত্র একটিই হতে পারে তাদের কাউকে বাইরে যেতে হবে। এই গোপন ল্যাবরেটরি থেকে যারা বাইরে যায় তারা আর কখনো ফিরে আসে না।
হ্যাঁ। তিশিনা মেয়েগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে বলল, একটা জরুরি কাজে এসেছি।
কী কাজ, তিশিনা?
বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে চিঠি এসেছে। তিশিনা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের একজনকে আমার নিয়ে যেতে হবে।
ফুটফুটে মেয়েগুলো কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। একজন খুব কষ্ট করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার কী মনে হয় জান তিশিনা?