নীরা ত্রাতিনা প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল, কী বলছ তুমি? আমাদের স্কাউটশিপে কোনো শীতল ঘর নেই! তার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে সে যেন পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না।
রিশান বলল, আছে।
কোথায় আছে?
এই পুরো স্কাউটশিপটাই হবে শীতল ঘর।
পুরো স্কাউটশিপটা– নীরার হঠাৎ মনে হতে থাকে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে সে যেন ঠিক করে কথা বলতে পারছে না। মনে হতে থাকে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। রিশান কী বলতে চাইছে সে যেন ঠিক করে বুঝতে পারছে না। চোখের সামনে রিশানকেও মনে হতে থাকে যেন অনেক দূরের কোনো মানুষ।
রিশান হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে আস্তে করে নীরার হাত ধরে বলল, নীরা! আমি তোমার পানীয়ের মাঝে খুব কড়া একটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি।
নীরা ত্রাতিনা বলতে চাইল, কেন? কিন্তু সে বলতে পারল না, টলে উঠে পড়ে যাচ্ছিল, রিশান তাকে ধরে ফেলল।
রিশান তাকে জড়িয়ে ধরে সাবধানে নিচে শুইয়ে দিয়ে বলল, নীরা, সোনামণি আমার! তোমাকে পরিষ্কার করে কখনো বলি নি, আমি যে শুধু তোমাকে খুব পছন্দ করি তা নয় আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। ভালবাসার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে কিছু নেই, তুমি আমাকে সেটা অনুভব করতে দিয়েছ। সেজন্য তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
নীরা ত্রাতিনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তার ঠোঁট দুটো শুধু একবার নড়ে উঠল।
রিশান নীরা ত্রাতিনার মাথার চুল স্পর্শ করে বলল, আমি জানি তুমি ঘুমিয়ে যাচ্ছ। তুমি আবছা আবছাভাবে আমার কথা শুনতে পাচ্ছ। একটু পরে আর শুনতে পাবে না। তোমাকে আমি অসম্ভব ভালবাসি নীরা, তাই তোমাকে আমি কিছুতেই মারা যেতে দেব না। মনে আছে তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুমি উনিশ জন সন্তানের মা হতে চাও? তুমি যদি। বেঁচে না থাক তাহলে কেমন করে উনিশ জন সন্তানের মা হবে? তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে নীরা। তোমাকে আমি বাচিয়ে রাখবই।
আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখব। তারপর খুব ধীরে ধীরে তোমার শরীরের তাপমাত্রা আমি কমিয়ে আনব। কেমন করে সেটা করব বুঝতে পারছ? আমাদের এই স্কাউটশিপের বাইরে হিমশীতল, তাই যখনই স্কাউটশিপের তাপ বন্ধ করে দেব এটা ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকবে। কিন্তু সেটা করতে হবে খুব সাবধানে। মানুষের শরীর অসম্ভব কোমল, তাকে খুব যত্ন করে শীতল করতে হয়।
তোমাকে হিমশীতল করে দেবার পর তোমার আর নিশ্বাস নিতে হবে না। স্কাউটশিপে কোনো অক্সিজেন না থাকলেও তুমি বেঁচে থাকবে। আমি নিশ্চিত মহাকাশ স্টেশনের ক্রুরা এই স্কাউটশিপটা খুঁজে বের করবে। তারপর তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে পৃথিবীতে। পৃথিবীর সেরা ডাক্তাররা তোমাকে বাঁচিয়ে তুলবে। আমি নিশ্চিত তারা তোমাকে বাচিয়ে তুলবে।
রিশান নীরার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইছ আমার কী হবে? জান নীরা, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রকে দেখতাম তখন ভাবতাম আহা, আমি যদি একটা নক্ষত্র হতে পারতাম! আজ আমার সেই স্বপ্ন সত্যি হবে। তোমাকে হিমশীতল করে দেবার পর আমি স্পেস সুট পরে এই স্কাউটশিপের দরজা খুলে মহাকাশে ঝাঁপিয়ে পড়ব! নিঃসীম মহাকাশে যেখানে কেউ নেই, চারপাশে ঘন কালো অন্ধকার সেখানে একা ভেসে থাকতে কী বিচিত্র একটা অনুভূতি হবে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব তোমাকে নিয়ে স্কাউটশিপটা দূরে চলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ছোট একটা বিল্টুর মতো সেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার স্পেস সুটের অক্সিজেন যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আমি সেই আশ্চর্য একাকিত্ব উপভোগ করব। তারপর আমি আকাশের নক্ষত্র হয়ে যাব। পৃথিবীতে তুমি যখন তোমার উনিশ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আকাশের দিকে তাকাবে তখন যদি ক্ষণিকের জন্য কোনো একটা অচেনা নক্ষত্রকে দেখ বুঝবে সেটা আমি।
নীরা ত্রাতিনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। রিশান দেখল তার অসহায় কালো দুটি চোখ অশ্রুসজল হয়ে আসছে। রিশান ধীরে ধীরে তার মুখ নামিয়ে এনে নীরা ত্রাতিনার ঠোঁট স্পর্শ করল।
.
নীরা ত্রাতিনার স্কাউটশিপটা মহাকাশ স্টেশনের ক্রুরা উদ্ধার করে ভেতরে তার হিমশীতল দেহটি আবিষ্কার করে। সেটি পৃথিবীতে পাঠানো হয় এবং পৃথিবীর একটি সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। রিশানকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। সম্ভবত সে সত্যি সত্যি আকাশ নক্ষত্র হয়ে হারিয়ে গেছে।
তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। নীরা ত্রাতিনা টেহলিস শহরের কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। তার উনিশটি সন্তানের শখ ছিল তার সেই শখ পূরণ হয়নি। রিশানের প্রতি ভালবাসার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সে কখনো বিয়ে করে নি– তার স্বামী বা সন্তান কোনোটাই কখনো ছিল না। উনিশটি দূরে থাকুক– একটিও নয়।
তবে সে জানত না মহাকাশের স্কাউটশিপ থেকে উদ্ধার করার পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে কি না সে বিষয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তা থাকার কারণে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তার খানিকটা টিস্যু সংরক্ষণ করেছিলেন– ভবিষ্যতে কখনো কোনোভাবে তাকে ক্লোন করার জন্য। নীরা ত্রাতিনা বেঁচে গিয়েছিল বলে তাকে ক্লোন করার প্রয়োজন হয় নি। তবে নীরা ত্রাতিনা কখনো জানতে পারে নি যে সবার অগোচরে টেহলিস শহর থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্রে খুব গোপনে তাকে ক্লোন করা হয়েছিল। চার দেয়ালে আটকে রাখা একটা গোপন ল্যাবরেটরিতে নীরা ত্রাতিনার ক্লোনেরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে।