চমৎকার।
দুই ঘণ্টার মাথায় নীরা ত্রাতিনা বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ঠিক করে ফেলল। স্কাউটশিপের ফাটলগুলো বুজিয়ে বাতাসের চাপ ঠিক করতে রিশানের লাগল চার ঘণ্টা। নীরা ত্রাতিনা মূল ইঞ্জিনটা চালু করল আরো দুই ঘণ্টায়। রিশান মূল কম্পিউটারটি চালু করতে আরো তিন ঘণ্টা সময় নিল। সবগুলো ইঞ্জিন সমন্বয় করতে এবং জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে নীরা ত্রাতিনার আরো দুই ঘণ্টা সময় লেগে গেল। তখন দুইজন মিলে ঘণ্টাখানেক যোগাযোগ মডিউলটা চালু করার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হল না। তাদের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে তাই যোগাযোগ মডিউলে পৃথিবী কিংবা মহাকাশ স্টেশনের সাথে যোগাযোগ না। করেই গ্রহাণু টোরকা থেকে তারা বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত হল।
নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হবার তিন ঘণ্টা আগে স্কাউটশিপটা গর্জন করে উপরে উঠে যায়, প্রথমে সেটি গ্রহাণুটাকে প্রদক্ষিণ করে কক্ষপথটা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নেয়, তারপর স্কাউটশিপের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করে পৃথিবীর দিকে ছুটিয়ে নিতে থাকে।
স্কাউটশিপের ভেতরে ককপিটে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা শান্ত হয়ে বসে থাকে, খুব ধীরে ধীরে স্কাউটশিপের গতিবেগ বাড়ছে। তারা ত্বরণটুকু অনুভব করতে ব্রু করেছে, মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি চেয়ারের সাথে তাদের চেপে ধরে রেখেছে। নীরা ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের নানা ধরনের মিটারগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে। যতই সময় যাচ্ছে ততই তারা এই গ্রহাণুটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিশ্চিত মৃত্যুর মতো যে গ্রহাণুটি পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে তারা সেটাকে ধ্বংস করার জন্য নিউক্লিয়ার বিস্ফোরক বসিয়ে এসেছে, আর কিছুক্ষণ তার পরেই মহাকাশে ভয়ংকর একটি বিস্ফোরণে সেটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষ কিংবা মহাকাশ স্টেশনের মহাকাশচারীদের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই, সত্যি সত্যি যখন গ্রহাণুটি ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তাদের আনন্দধ্বনিটুকু তারা শুনতে পাবে না সত্যি কিন্তু সেটা পুরোপুরি অনুভব করতে পারবে।
গ্রহাণু টোরকা যখন বিস্ফোরিত হল স্কাউটশিপের মনিটরে তারা শুধুমাত্র একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। বায়ুহীন মহাশূন্যে সেটি ছিল নিঃশব্দ। পুরো গ্রহাণুটি প্রায় ভস্মীভূত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যায়। স্কাউটশিপের রেডিয়েশন মনিটরে কয়েক মিনিট গামা-রে রেডিয়েশনের শব্দ শোনা গেল তারপর সেটি পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে গেল। নীরা ত্রাতিনা এতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিল, এবার বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা একটা। নিশ্বাসকে বের করে দিয়ে সে রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা তা হলে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পেরেছি।
হ্যাঁ। রিশান মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীর আট বিলিয়ন মানুষ সেজন্য এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই তোমাকে এবং আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
হতচ্ছাড়া কমিউনিকেশন মডিউলটি ঠিক থাকলে আমরা এখন তাদের কথা শুনতে পেতাম।
ঠিক বলেছ। রিশান বলল, কথা না শুনলেও কি তাদের আনন্দটুকু অনুভব করতে পারছ না?
পারছি। নীরা আতিনা বলল, সত্যি পারছি।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্য আমাদের বিশেষ একটা কিছু করা দরকার।
নীরা ত্রাতিনা হেসে বলল, তুমি বিশেষ কী করতে চাও?
অন্ততপক্ষে দুজনের খানিকটা উত্তেজক পানীয় খাওয়া দরকার।
এই স্কাউট স্টেশনে খাবার পানি পরিশোধন করে খেতে হয় তুমি উত্তেজক পানীয় কোথায় পাবে?
রিশান বলল, এসব ব্যাপারে আমি খুব বড় এক্সপার্ট! আমাকে দুই মিনিট সময় দাও!
ঠিক আছে। নীরা খিলখিল করে হেসে বলল, তোমাকে দুই মিনিট সময় দেওয়া গেল।
দুই মিনিট শেষ হবার আগেই রিশান কটকটে লাল রঙের দুই গ্লাস পানীয় নিয়ে আসে। দুজন গ্লাস দুটো উঁচু করে ধরে, রিশান বলল, পৃথিবীর মানুষের নবজীবনের উদ্দেশ্যে।
নীরা ত্রাতিনা প্রতিধ্বনিত করে বলল, নবজীবনের উদ্দেশ্যে।
তারপর দুজন তাদের পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেয়। রিশান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলল, কেমন হয়েছে আমার এই পানীয়?
খেতে মন্দ নয়। তবে
তবে কী?
কেমন জানি ওষুধ ওষুধ গন্ধ।
রিশান হাসার চেষ্টা করে বলল, ওষুধ দিয়ে তৈরি করেছি, একটু ওষুধ ওষুধ গন্ধ তো হতেই পারে।
দুজন আবার তাদের পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেয়। নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা শুধু শুধু যে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করেছি তা নয়, আমরা নিজেরাও বেঁচে গিয়েছি।
রিশান কিছুক্ষণ নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রায়।
নীরা ত্রাতিনা একটু চমকে উঠে বলল, প্ৰায়?
হ্যাঁ। নীরা, আমরা এখনো পুরোপুরি বেঁচে যাই নি। তোমাকে যে কথাটা বলা হয় নি সেটি হচ্ছে– রিশান হঠাৎ থেমে যায়।
সেটি কী?
আমাদের স্কাউটশিপে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই।
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। সব মিলিয়ে দুজনের আরো কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন রয়েছে।
নীরা ত্রাতিনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ করে তার মাথাটা একটু ঘুরে ওঠে।
রিশান বলল, কাজেই যদি আমরা বেঁচে থাকতে চাই তা হলে আমাদের কিছু অস্বাভাবিক কাজ করতে হবে।
কী অস্বাভাবিক কাজ?
আমাদের শীতল ঘরে ঘুমিয়ে যেতে হবে। শীতল ঘরে শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় থাকলে মানুষকে নিশ্বাস নিতে হয় না।