স্কাউটশিপটার গুরুতর ক্ষতি হয়েছে, অনেকগুলো এলার্ম একসাথে তারস্বরে বাজতে শুরু করেছে। বৈদ্যুতিক যোগাযোগে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে স্কাউটশিপের আলো নিতে গিয়েছে। পোড়া একটা ঝাঁজালো গন্ধে পুরো স্কাউটশিপটা ধীরে ধীরে ভরে যেতে শুরু করে।
যন্ত্রপাতির নিচে চাপা পড়ে থাকা রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা বের হয়ে এল। একজন আরেকজনের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকে। নীরা ত্রাতিনা বলল, এটা কী হল?
রিশান মাথা নাড়ে, বুঝতে পারছি না।
মনে হচ্ছে গ্রহাণুর মাঝখানে একটা নিউট্রন স্টার হাজির হয়েছে। হঠাৎ করে স্কাউটশিপটাকে এভাবে টেনে নিল কেন?
ম্যাগনেটিক ফিল্ড। আমরা যতটুকু ভেবেছিলাম তার থেকে কয়েক শ গুণ বেশি। গ্রহাণুটা ঘুরছে সেজন্য চৌম্বক আবেশ দিয়ে আশপাশে তীব্র ফিল্ড তৈরি করেছে। আমরা বুঝতে পারি নি।
নীরা ত্রাতিনা চারদিকে তাকিয়ে বলল, স্কাউটশিপটা মনে হয় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।
রিশান মাথা নাড়ল, ফাটল দিয়ে সব বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্পেস সুট পরে নেওয়া দরকার।
একটা স্পেস সুটে বড়জোর দশ-বারো ঘণ্টার মতো অক্সিজেন থাকে। তারপর কী হবে সেটা নিয়ে দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা প্রায় নিঃশব্দে স্পেস সুট পরে নেয়। স্কাউটশিপের ক্ষতির পরিমাণটা একটু অনুমান করার চেষ্টা করল। ফাটলগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয় কাজেই সেখানে সময় নষ্ট করল না। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কমিউনিকেশান মডিউলটি কাজ করছে না। পৃথিবী বা স্পেস স্টেশনের সাথেও আর কথা বলা যাচ্ছে না।
নীরা ত্রাতিনা বলল, চল, নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি তাড়াতাড়ি গ্রহাণুটার মাঝে বসিয়ে আসি।
হ্যাঁ। দেরি করে লাভ নেই। চল।
দুজন স্কাউটশিপের হ্যাঁচ খুলে সেখান থেকে বিস্ফোরকগুলো বের করে নেয়। ভরশূন্য পরিবেশ, কিন্তু গ্রহাণুটার প্রচণ্ড চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে জুতোর নিচে লাগানো লোহার পাতগুলো তাদের গ্রহাণুটাতে আটকে থাকতে সাহায্য করছিল। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি নিয়ে তারা একটা ছোট জেটপ্যাক নিয়ে রওনা দেয়। গ্রহাণুটার মোটামুটি মাঝামাঝি অংশে তারা নেমেছে, এর মূল কেন্দ্রের কাছাকাছি জায়গায় একটা গভীর গর্ত করে সেখানে বিস্ফোরকটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। গর্তটা যত গম্ভীর হবে গ্রহটাকে ধ্বংস করার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে।
রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে গর্ত করতে শুরু করে। ধারালো ড্রিল মেশিনটি আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে গর্ত করতে শুরু করে, থরথর করে কাঁপতে থাকে কুৎসিত গ্রহাণুটির লালচে পাথর।
ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই প্রায় এক কিলোমিটার গভীর একটা গর্ত তৈরি হয়ে যায়। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকের টাইমারটি সেট করে এখন সেটা নামিয়ে উপর থেকে গর্তটা বন্ধ করে দিতে হবে। নীরা ত্রাতিনা প্রশ্ন দৃষ্টিতে বিশানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা টাইমারটি কতক্ষণ পরে সেট করব?
রিশান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে এটি সেট করতে হবে যেন আমরা এর মাঝে স্কাউটশিপটা ঠিক করে দূরে সরে যেতে পারি।
নীরা ত্রাতিনা বলল, আবার খুব বেশি সময় দেওয়া যাবে না। যদি কোনো কারণে বিস্ফোরকটা কাজ না করে তা হলে যেন দ্বিতীয় একটা দল আসতে পারে তার সময় দিতে হবে।
হ্যাঁ। রিশান মাথা নাড়ল, ঠিকই বলেছ।
টাইমারটিকে বারো ঘণ্টার জন্য সেট করে তারা বিস্ফোরকটার ভেতরে নামিয়ে দিল। ওপর থেকে গর্তটা বুজিয়ে দিয়ে তারা স্কাউটশিপে ফিরে আসতে থাকে। তাদের হাতে এখন বারো ঘণ্টার মতো সময় তার ভেতরে স্কাউটশিপটাকে চালু করে তাদের সরে যেতে হবে। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে পুরো গ্রহাণটা যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তখন তার টুকরোগুলো চারপাশে যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করবে তার কয়েক শ কিলোমিটারের ভেতর কোনো জীবন্ত প্রাণীর বেঁচে থাকার কথা নয়।
রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা স্কাউটশিপের ভেতর ঢুকে তার ধাতব দরজা বন্ধ করে, পুরোটা এক ধরনের বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। রিশান চারদিকে তাকিয়ে বলল, আগামী ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতর আমাদের স্কাউটশিপটা চালু করতে হবে, তারপর ছয় থেকে আট ঘন্টায় আমাদের এই গ্রহাণু টোরকা থেকে সরে যেতে হবে। যদি না পারি আমাদের শরীরের একটা পরমাণুও কেউ কখনো খুঁজে পাবে না।
নীরা ত্রাতিনা চারদিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী ধারণা? স্কাউটশিপটা যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে সেটাকে কি ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে ঠিক করা যাবে?
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, মনে হয় না।
আমারও তাই ধারণা। তবে-
তবে কী?
যদি আমরা এটাকে ছয় থেকে আট ঘণ্টার মাঝে দাঁড়া করাতে না পারি তা হলে আর কখনোই দাঁড়া করাতে পারব না। কাজেই মন খারাপ করার কিছু নেই!
রিশান হাসার চেষ্টা করে বলল, বিষয়টা নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ নীরা! আমি মোটেও মন খারাপ করছি না।
তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক।
নীরা ত্রাতিনা বলল, আমি অক্সিজেন সাপ্লইটা দেখি। তুমি দেখ ইঞ্জিনগুলো।
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, না, আমি অক্সিজেন সাপ্লাইটুকু দেখি তুমি ইঞ্জিনগুলো দেখ। ইঞ্জিনটা দেখার আগে বৈদ্যুতিক যোগাযোগটাও তোমাকে দেখতে হবে। আমি ইমার্জেন্সি পাওয়ার ব্যবহার করে স্কাউটশিপের কম্পিউটারটা চালু করার চেষ্টা করি।