রিশান হেসে বলল, অনুমান করছি সপ্তাহখানেকের ভেতরেই তোমার যথেষ্ট ঘুম হয়ে যাবে। তখন কী করবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবার ইচ্ছে আছে। মহাজাগতিক নিউক্লিয়াস নিয়ে একটা জিনিস অনেক দিন থেকে মাথায় কুটকুট করছে। বিষয়টা নিয়ে একটা বড় এক্সপেরিমেন্ট করব ভাবছি।
হুম! রিশান মুখ গম্ভীর করে বলল, শুধু পড়াশোনা এবং গবেষণা! আমি শুনেছিলাম মেয়েরা নাকি ঘর-সংসার করতেও খুব পছন্দ করে।
করি। আমিও করি। ঘর-সংসার বাচ্চাকাচ্চা আমার খুব পছন্দ। নীরা ত্রাতিনা মুচকি হেসে বলল, আমি ঠিক করেছি আমি যখন সংসার শুরু করব তখন আমার উনিশ জন বাচ্চা হবে।
রিশান চোখ কপালে তুলে বলল, কতজন?
উনিশ জন। তার থেকে একজনও কম নয়!
রিশান শব্দ করে হেসে বলল, আমি তোমার সাফল্য কামনা করছি নীরা।
নীরা ত্রাতিনা এবারে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, পৃথিবীতে ফিরে তুমি কী করবে?
আমি?
হ্যাঁ।
রিশান মাথা চুলকে বলল, এখনো ঠিক করি নি। তুমি কোন হ্রদের তীরে কটেজ ভাড়া করবে যদি বলো তা হলে সেই হ্রদে মাছ ধরতে যেতে পারি।
নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি বুঝি মাছ খেতে খুব পছন্দ কর?
উঁহু।
তা হলে?
আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি!
নীরা ত্রাতিনা আবার খিলখিল করে হাসতে গিয়ে থেমে গেল, রিশানের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, একটা ছোট স্কাউটশিপে কাউকে নিয়ে দিনের পর দিন মহাকাশে ছুটে যেতে হলে পছন্দ না করে উপায় কী?
রিশান বলল, আসলে বিষয়টা এত সহজ না।
তা হলে বিষয়টা কী?
টোরকা গ্রহাণুটা পৃথিবীর জন্য খুব ভয়ংকর একটা বিপদ। আমাদের যে করেই হোক এটা ধ্বংস করতে হবে। আমরা যদি এখন এটা ধ্বংস করতে না পারি পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তুমি বুঝতে পারছ, কাজটা খুব কঠিন। আমরা যেটা করছি এর আগে সেটা কেউ করে নি। যতই কাছে যাচ্ছি ততই বুঝতে পারছি কাজটা কত বিপজ্জনক। গ্রহাণুটা অত্যন্ত বিচিত্রভাবে ঘুরছে, পুরোটা এবড়োখেবড়ো-বিশাল বিশাল পাথরের চাই উঁচু হয়ে আছে, ডক করার সময় আমাদের স্কাউটশিপ টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণটা ঘটার সময় আমাদের স্কাউটশিপটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। আমরা নিজেদের কাছে নিজেরা স্বীকার করছি না, কিন্তু দুজনেই খুব ভালো করে জানি এখান থেকে জীবন্ত ফিরে যাবার সম্ভাবনা কম!
নীরা ত্রাতিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, কেন ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ?
আমি মোটেই তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না। রিশান একটু হেসে বলল, তোমাকে আমি অনেক দিন থেকে খুব কৌতূহল নিয়ে লক্ষ করছি–তোমার ভিতরে কোনো ভয়ডর নেই। শুধু যে নিজের ভিতরে নেই তা নয়, যারা তোমার আশপাশে থাকে তারাও তোমার সাহসটুকু পেয়ে যায়–তোমাকে ভয় দেখাব কেমন করে? আমি যেটা বলছি সত্যি বলছি। তোমার কিংবা আমার কিংবা আমাদের দুজনেরই কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। তুমি জান?
নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি।
তাই আমি ভাবছিলাম যখন দুজনই বেঁচে আছি তখন তোমাকে কথাটা জানিয়ে রাখি। তুমি খুব চমৎকার মেয়ে নীরা। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। কথাটি এখনই বলছি কারণ এই কথাটি হয়তো আর কখনো বলার সুযোগ পাব না।
নীরা ত্রাতিনা কিছুক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কোন হ্রদের তীরে কটেজ ভাড়া করব সেটা তোমাকে জানিয়ে রাখব রিশান। তুমি মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে এই কথাগুলো বলার অনেক সুযোগ পাবে।
সত্যি?
হ্যাঁ। নীরা ত্রাতিনা একটু হেসে বলল, সত্যি।
২. টোরকা গ্রহাণুটা দেখতে অত্যন্ত বীভৎস
টোরকা গ্রহাণুটা দেখতে অত্যন্ত বীভৎস। এটি লালচে, দেখে মনে হয় বিশাল কোনো প্রাণীর চামড়া ছিলে ভেতরের মাংস ক্লেদ বের করে রাখা হয়েছে। গ্রহাণুটি দুটি ভিন্ন ভিন্ন অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে-মূল অংশ থেকে এবড়োখেবড়োভাবে বের হয়ে থাকা অংশগুলো এত বিপজ্জনকভাবে ঘুরে আসছে যে স্কাউটশিপটা সেখানে মানো খুব বিপজ্জনক হতে পারে। গ্রহাণুটাতে নামার আগে নীরা ত্রাতিনা আর রিশান টোরকাকে ঘিরে একটা স্থির কক্ষপথ তৈরি করে নিল, তারপর একটা সমতল অংশ দেখে খুব সাবধানে সেখানে নেমে আসতে থাকে।
গ্রহাণুটার কয়েকশ মিটার কাছাকাছি এসে তারা মূল ইঞ্জিন বন্ধ করে ছোট ছোট দুটো ইঞ্জিন চালু করে এবং হঠাৎ করে একটি বিপজ্জনক অবস্থার মুখোমুখি হয়ে যায়। কোনো একটা বিচিত্র কারণে গ্রহাণুটা প্রচণ্ড শক্তিতে তাদের স্কাউটশিপটাকে নিচে টেনে নামাতে থাকে। রিশান কন্ট্রোল প্যানেলে বসে চিৎকার করে বলল, মূল ইঞ্জিন বিপরীত থ্রাস্ট।
নীরা ত্রাতিনা দ্রুত আবার মূল ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করে, সেটি চালু হতে খানিকটা সময় নেয়, কিন্তু ততক্ষণে স্কাউটশিপটা প্রচণ্ড গতিতে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। গ্রহাণুটার বের হয়ে থাকা একটা অংশ স্কাউটশিপটাকে একটু হলে আঘাত করে ফেলত, শেষ মুহূর্তে রিশান এটাকে সরিয়ে নেয়। গতি কমানোর জন্য মূল ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করছে, পারছে না-যখন তারা বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন একেবারে শেষ মুহূর্তে ইঞ্জিনটা চালু হয়ে যায়। তারপরেও তারা স্কাউটশিপটা পুরোপুরি বাঁচাতে পারল না। প্রচণ্ড গতিতে ভয়ংকর বিস্ফোরণ করে সেটা গ্রহাণুটাতে আছড়ে পড়ে।