গ্রহাণুটি এখনো অনেকখানি দূরে কিন্তু সেটা কাছে আসার জন্য কেউই অপেক্ষা করতে রাজি নয়। এটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধ্বংস করা দরকার তাই রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা খুব তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মচারীরা স্কাউটশিপে দুটি হালকা নিউক্লিয়ার বোমা তুলে দেয়। স্কাউটশিপে জ্বালানি ভরতে অনেক সময় লেগে গেল। সেখানকার মূল কম্পিউটারে মহাকাশ স্টেশন এবং পৃথিবী থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রবেশ করিয়ে শেষ পর্যন্ত স্কাউটশিপটাকে রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত করে নেওয়া হল।
মহাকাশযানের ইঞ্জিনিয়াররা যখন স্কাউটশিপটার যান্ত্রিক ঘুঁটিনাটি শেষবারের মতো পরীক্ষা করছে তখন বায়ু নিরোধক গোলাকার হ্যাঁচ দিয়ে রিশান আর নীরা ত্রাতিনা তাদের স্কাউটশিপে গিয়ে ঢোকে। ধাতব দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে দু জনে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারে বসে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই কাউন্ট ডাউন রু হয়ে যায়। সামনে বড় মনিটরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অফিসারদের দেখা যায়, তারা গম্ভীর গলায় কিছু রুটিন চেকআপ করে নেয়। নীরা ত্রাতিনা আর রিশান তাদের অভিজ্ঞ হাতে কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ স্পর্শ করে পুরো স্কাউটশিপটাকে সচল করতে থাকে।
কিছুক্ষণের ভেতরেই একটা চাপা গুম গুম শব্দ করে স্কাউটশিপটা গভীর মহাকাশের দিকে ছুটতে থাকে।
.
পৃথিবীর মহাকর্ষ থেকে বের হবার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে স্কাউটশিপটা তার গতি সঞ্চয় করতে থাকে। মহাকাশযানের ককপিটে বসে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা তার তৃরণটুকু অনুভব করতে শুরু করে। তাদের মনে হতে থাকে অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি তাদেরকে চেয়ারে চেপে ধরেছে। রিশান কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে বলল, নীরা, সবকিছু ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিক আছে।
তুমি যদি সহ্য করতে পার তা হলে গতিবেগ আরো দ্রুত বাড়িয়ে ফেলি।
আমি সহ্য করতে পারব।
চমৎকার। রিশান থ্রটল বারটা নিজের কাছে টেনে আনতে আনতে বলল, তোমার মতো মহাকাশচারীকে নিয়ে উড়ে যাওয়ার একটা আনন্দ আছে। আমার সাথে আসার জন্য ধন্যবাদ নীরা।
ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে যেতে পারা আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য।
রিশানের খুব ইচ্ছে হল বলে যে, তোমার সাথে পাশাপাশি যেতে পারাও আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য! সে সেটি বলতে পারল না। ইঞ্জিনের গর্জনের সাথে সাথে গতিবেগ বাড়তে থাকে, প্রচণ্ড ত্বরণের কারণে তাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় বুকের উপর কেউ একটা বিশাল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। তাদের চোখের সামনে একটা লাল পরদা কাঁপতে থাকে। মনে হতে থাকে আর একটু হলেই তারা অচেতন হয়ে যাবে। দুজন দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে বসে থাকে, রিশান চোখের কোনা দিয়ে নীরা ত্রাতিনাকে দেখার চেষ্টা করে। তাকে বলার ইচ্ছে করে, তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি নীরা। কিন্তু সে সেটাও বলতে পারে না। মহাকাশযানের দুটি ইঞ্জিন প্রচণ্ড গর্জন করছে, পুরো স্কাউটশিপটি থরথর করে কাঁপছে, শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এরকম একটা সময়ে কেউ এ ধরনের একটি কথা বলে না। রিশান তাই সেটি বলার চেষ্টা করল না।
ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই স্কাউটশিপটা তাদের কাঙ্ক্ষিত গতিবেগে পৌঁছে যায়। তৃরণটি বন্ধ করার সাথে সাথে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনার নিজেদেরকে ভরশূন্য মনে হতে থাকে। দুজনেই এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। মহাকাশের অন্ধকারে এখন তাদের শুধু ছুটে যাওয়া। যতই সময় পার হবে তাদের যাত্রা হবে আরো বিপজ্জনক। ছোটবড় অসংখ্য গ্রহাণুর ভেতর দিয়ে তাদের উড়ে যেতে হবে। টোরকা গ্রহাণুটা এখনো অনেক দূরে, সেখানে পৌঁছাতে এখনো তাদের অনেক দিন বাকি।
পরের কয়েকদিন রিশান আর নীরা ত্রাতিনা ছোট স্কাউটশিপটার মাঝে টোরকা গ্রহাণুটাতে পৌঁছানোর পর তার ওপর নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকগুলো বসানোর ঘুঁটিনাটি পরিকল্পনা করে কাটিয়ে দিল। পৃথিবীর মহাকাশ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ আছে, মহাকাশ স্টেশনের সাথেও যোগাযোগ আছে। তাদের স্কাউট স্টেশনের গতিপথ আর টোরকা গ্রহাণুর গতিপথ হিসাব করে তাদের স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ মডিউলের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। রিশান আর নীরা ত্রাতিনা এর মাঝে বেশ কয়েকবার পুরো পরিকল্পনাটা পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে।
দুজন মানুষ খুব কাছাকাছি একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে থাকলে তাদের মাঝে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতার জন্ম হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। দুজন যে শুধুমাত্র গতিপথ আর বিস্ফোরক নিয়ে কথা বলল তা নয়, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, প্রিয়-অপ্রিয়, ভালো লাগা এবং না লাগার বিষয় নিয়েও কথা বলল। টোরকা গ্রহের কাছাকাছি যেদিন পৌঁছে গেছে সেদিন নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকের ডেটনেটরগুলো শেষবারের মতো পরীক্ষা করতে করতে রিশান নীরা ত্রাতিনাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে কী করবে, ঠিক করেছ?
হ্যাঁ।
কী করবে?
হ্রদের তীরে একটা কটেজ ভাড়া করে সেখানে ওক কাঠের শক্ত একটা বিছানায় ঘুমাব। ভরশূন্য অবস্থায় বাতাসে ঝুলে ঝুলে ঘুমাতে ঘুমাতে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।