তাদের ভেতরে আসতে দেবে না?
না। তুমি সুস্থ না হলে কাউকে ভেতরে আসতে দেবে না।
নায়ীরার চোখ-মুখের ঔজ্জ্বল্য আবার দপ করে নিভে গেল। সে নিচু গলায় বলল, কিন্তু আমি তো আর সুস্থ হব না মা।
ত্রাতিনা নায়ীরার হাত ধরে বলল, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা কর।
নায়ীরা নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে চোখ বন্ধ করল।
.
ড. নিশিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর ত্রাতিনা। আমি খুব দুঃখিত।
নীরা ত্রাতিনা হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে থাকা নায়ীরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী নিষ্পাপ একটি মুখমণ্ডল! সে যখন পনের বছরের একটা কিশোরী ছিল তখন কি তার মুখমণ্ডল এত নিষ্পাপ ছিল? এইটুকুন মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অবিচারটির মুখোশ খুলে দিয়েছে, এখনো সেটি নীরা ত্রাতিনা বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ এই মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে না?
নীরা ত্রাতিনা ড. নিশিরার দিকে তাকিয়ে বলল, সারা পৃথিবীর মানুষ এই মেয়েটির জন্য প্রার্থনা করছে।
আমি জানি।
হাসপাতালের বাইরে হাজার হাজার স্কুলের ছেলেমেয়ে ফুল নিয়ে এসেছে, তুমি দেখেছ?
দেখেছি।
কিন্তু এই মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে না?
না প্রফেসর ত্রাতিনা। প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভয়ানক মানুষগুলো তার শরীরকে ভাইরাস জন্মানোর জন্য ব্যবহার করেছে। সেই ভাইরাসগুলো মস্তিষ্ক ছাড়া তার প্রত্যেকটি অঙ্গ কুরে কুরে খেয়েছে। তার হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, কিডনি, ফুসফুস কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই মেয়েটি কেমন করে এখনো বেঁচে আছে সেটিই একটি রহস্য।
তাকে কোনোভাবে বাঁচানো যাবে না?
না।
কোনোভাবেই না?
না, প্রফেসর লাতিনা, কোনোভাবেই না। এই মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে তার শরীরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বদলে দিতে হবে। তার দরকার নতুন একটি হৃৎপিণ্ড, নতুন যকৃত, নতুন কিডনি, নতুন ফুসফুস-এক কথায় একটা নতুন দেহ। কোথা থেকে সেটা পাবে?
যদি কেউ দিতে রাজি হয়?
কে রাজি হবে? তা ছাড়া রাজি হলেই তো হবে না। তার শরীরের সঙ্গে সেগুলো মিলতে হবে। সেটি তো সম্ভব নয়। একটি-দুটি অঙ্গ মেলানো যায়, কিন্তু প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ?
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, তুমি জান নায়ীরা আমার ক্লোন?
হ্যাঁ, জানি।
তার মানে জান?
ড. নিশিরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ প্রফেসর ত্রাতিনা?
আমি বলতে চাইছি যে, আমার প্রত্যেকটি অঙ্গ নায়ীরা ব্যবহার করতে পারবে। আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আমি চেকআপ করিয়েছি, আমি সুস্থ সবল আর নীরোগ।
ড. নিশিরা খপ করে ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, না, প্রফেসর ত্রাতিনা, এটা হতে পারে না! অসম্ভব
নীরা ত্রাতিনা ড. নিশিরার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল, তোমার ছেলেমেয়ে আছে?
হ্যাঁ আছে।
কত জন?
দুজন। কিন্তু তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
যদি কখনো এরকম হয়, তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তোমার প্রাণ দিতে হয়, তুমি কি তোমার প্রাণ দেবে?
কাল্পনিক প্রশ্ন করো না প্রফেসর ত্রাতিনা।
এটা কাল্পনিক প্রশ্ন না। আমি জানি তুমি দেবে। একজন মায়ের কাছে তার নিজের জীবন থেকে সন্তানের জীবন অনেক বড়। নায়ীরা আমার সন্তান। তুমি যদি তোমার সন্তানের জন্য প্রাণ দিতে পার, আমি কেন পারব না? ত্রাতিনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ড. নিশিরা তুমি অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত হও।
না, প্রফেসর ত্রাতিনা, এটা হতে পারে না। তুমি পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী-
একজন মানুষ তার জীবনে যা পেতে পারে আমি তার সব পেয়েছি। নায়ীরা কিছু পায়নি, সে শুধু দিয়েছে। তাকে আমি ছোট একটা জীবন উপহার দিতে চাই।
না, ত্রাতিনা, না
আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ। আমার নিজের মধ্যে বেঁচে থাকা আর নায়ীরার মধ্যে বেঁচে থাকা আমার জন্য একই ব্যাপার।
না, না, প্রফেসর ত্রাতিনা। ড. নিশিরা কঠিন গলায় বলল, তুমি এটা করতে পার না।
আমাকে তুমি বাধা দিও না। নীরা ত্রাতিনা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আর বাধা দিয়েও লাভ নেই, নায়ীরাকে পৃথিবীর সবাই মিলে থামাতে পারে নি। আমাকেও পারবে না। আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ, তুমি তো জান।
ড. নিশিরা হতচকিত চোখে নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। নীরা ত্রাতিনা মৃদুস্বরে বলল, বিদায়।
ড. নিশিরা কিছু বলল না, কিন্তু সে জানে কথাটি মুখে উচ্চারণ করা না হলেও এ যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। চিরদিনের জন্যই।
.
প্রফেসর নীরা ত্রাতিনার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এক রকম চেহারার এগার জন কিশোরী তার কফিনটি বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। নায়ীরা তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি। হুইল চেয়ারে করে তাকে পিছু পিছু ঠেলে নিয়ে গেছে তিহান নামের একজন সুদর্শন তরুণ।
পৃথিবীর অন্য সব মানুষের সঙ্গে একসময় যাদের অবমানব বলা হত তারাও সেই অনুষ্ঠানটি দেখেছিল। নায়ীরাকে তার চোখের পানি মুছে নিতে দেখে পৃথিবীর অনেক মানুষও তাদের চোখের পানি মুছে নিয়েছিল।
সেই চোখের পানি ছিল একই সঙ্গে দুঃখের এবং ভালবাসার।
মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসার।