নীরা ত্রাতিনা নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে বলল, আমি তোমাকে জন্ম দিই নি, কিন্তু তুমি আমার মেয়ে। নায়ীরা, মা আমার, তুমি এতদিন পর কেন এসেছ?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, মা, তোমার ঠিক আমার মতো আরো দশটি মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। তারা খুব দুঃখী মেয়ে। তুমি তাদের দেখবে না?
দেখব, নিশ্চয়ই দেখব।
নায়ীরার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে চোখ বুজল।
নীরা ত্রাতিনা নায়ীরার মাথাটা নিজের কোলে রেখে তার পকেট থেকে ফোন বের করে একটি নম্বর ডায়াল করল। কানেকশন হওয়ার পর স্ক্রিনে কঠোর চেহারার একজন মানুষকে দেখা যায়। নীরা ত্রাতিনা নিচু গলায় বলল, আমি প্রফেসর নীরা ত্রাতিনা। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই।
রাষ্ট্রপতি এই মুহূর্তে একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন-
নীরা তাকে বাধা দিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা আছে। তাকে তুমি বলো, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমি তাকে জানাতে চাই।
ঠিক আছে, বলছি।
নীরা ত্রাতিনা হেলিকপ্টারের মেঝেতে নায়ীরার মাথাটি কোলে নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। হেলিকপ্টারের সিটে শক্ত করে বেঁধে রাখা চার জন বিজ্ঞান এবং সেনা কর্মকর্তার হাত-পা শক্ত করে বেঁধে রাখার কারণে সেখানে ঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন না হয়ে সেগুলো অবশ হয়ে আসছিল, কিন্তু কর্মকর্তাদের কেউই সেই বিষয়টি নিয়ে বিচলিত ছিল না। তাদের বিচলিত হওয়ার জন্য অনেক বড় বিষয় অপেক্ষা করছে, সেটি সম্পর্কে তাদের তখন আর কোনো সন্দেহ নেই।
.
নায়ীরা যখন চোখ খুলে তাকাল সে তখন হাসপাতালের একটি বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে অসংখ্য মনিটর। শরীরের নানা জায়গা থেকে অনেকগুলো সেন্সর সেই মনিটরগুলোতে এসেছে। শরীরের রক্ত বিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া দিয়ে তার দেহটি ভাইরাসমুক্ত করা চলছে। পদ্ধতিটি কার্যকর, তবে সময়সাপেক্ষ। নায়ীরা মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তার মাথার কাছে নীরা ত্রাতিনা দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীরাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে সে তার কাছে এগিয়ে এসে তার হাত স্পর্শ করল, জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কেমন আছ?
মনে হয় ভালোই আছি। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এখন কয়টা বাজে?
রাত একটা।
এত রাত?
হ্যাঁ, অনেক রাত।
মা, তুমি কি অবমানবদের রক্ষা করেছ?
হ্যাঁ, তাদের রক্ষা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে কয়েক শ হেলিকপ্টার অবমানবদের এলাকায় উড়ে যাচ্ছে তাদের সাহায্য করার জন্য।
সেখানে একটা গ্রামে তিহান নামে একটা ছেলে থাকে।
কী করে তিহান?
হরিণ শিকার করে। কিন্তু সে হরিণকে মারতে চায় না, তাই হরিণ শিকার করার সময় মুখে একটা দানবের মুখোশ পরে থাকে।
ভারি মজার ছেলে তো?
হ্যাঁ মা, সে খুব মজার ছেলে। নায়ীরা একটু অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু শুধু মজার ছেলে নয়, সে খুব কাজের ছেলে। আমরা যখন হেলিকপ্টারটা দখল করেছি তখন সে খুব সাহায্য করেছে। তার সঙ্গে যদি তোমার কখনো লেখা হয়, তুমি আমার পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিও।
দেব, নিশ্চয়ই দেব।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মা।
বলো, মা।
আমার যে আরো দশটি বোন আছে তাদের কী হবে মা?
তাদের উদ্ধার করার জন্য বিশেষ কমান্ডো বাহিনী পাঠানো হয়েছে।
তুমি তাদের দেখলে অবাক হয়ে যাবে। তাদের কথা আমি এক মুহূর্ত ভুলতে পারি না।
আমি সেটা বুঝতে পারি।
তারা কি এখানে আসবে?
হ্যাঁ। আসবে, অবশ্যই আসবে।
নায়ীরা উত্তেজনায় উঠে বসার চেষ্টা করল, নীরা ত্রাতিনা তাকে শান্ত করে শুইয়ে রাখে। নায়ীরা জ্বলজ্বলে চোখে জিজ্ঞেস করল, কবে আসবে?
সবকিছু শেষ করে আসতে আসতে তাদের বেশ কয়েক দিন লেগে যাবে।
ও! হঠাৎ করে নায়ীরার উত্তেজনা দপ করে নিভে গেল। ফিসফিস করে বলল, কয়েক দিন পর তো আমি বেঁচে থাকব না।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। এই রাতটি আমার শেষ রাত। আমি জানি।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে নায়ীরার হাতটি নিজের হাতে তুলে নেয়। নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি যদি নাও থাকি তুমি তো থাকবে। তারা একটা বোনকে হারিয়ে একটা মা পাবে। তাই না মা?
ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে নায়ীরার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পর নায়ীরা আবার ডাকল, মা।
বলো নায়ীরা।
পৃথিবীর মানুষ কি সবকিছু জেনে গেছে?
হ্যাঁ, তারা সবকিছু জেনেছে।
তারা কী বলছে, মা?
তারা প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর ভীষণ রেগেছে। তাদের সদর দপ্তর পুড়িয়ে দিয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষ অবমানবের দেশে যাচ্ছে তাদের দেখতে, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে।
সত্যি?
সত্যি মা। সারা পৃথিবীতে সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে, তুমি জান?
কে?
তুমি।
আমি?
হ্যাঁ।
নীরা আতিনা মিষ্টি করে হাসল, বলল, তুমি কেমন করে অবমানবের দেশে গিয়ে তাদের রক্ষা করেছ পৃথিবীর সব মানুষ সে কাহিনী জানে। টেলিভিশনে এখন তোমার ওপর একটু পরপর বুলেটিন প্রকাশ করছে। পৃথিবীর সকল মানুষ তোমার জন্য প্রার্থনা করছে।
নায়ীরা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, সত্যি মা? সত্যি?
হ্যাঁ। এই হাসপাতালের বাইরে হাজার হাজার স্কুলের ছেলেমেয়েরা তোমার জন্য ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।