মানুষটিকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে নীরা ত্রাতিনা বলল, তুমি ভেতরে বাচ্চা মেয়েটিকে জানাও যে, আমি তার সঁঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
মানুষটি বিরস মুখে টেলিফোনে কার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলল। তারপর তাকে হেলিকপ্টারের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বলল, এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাও। দরজায় টোকা দিলে খুলে দেবে। তবে আমি শেষবারের মতো বলছি–
নীরা ত্রাতিনা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজায় টোকা দিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুট করে খুলে গেল। নীরা ভেতরে ঢুকে চারদিকে তাকাল। বড় একটা হেলিকপ্টারের সামনের চারটা সিটে চার জন মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। হেলিকপ্টারের দরজা যে খুলেছে সে সম্ভবত হেলিকপ্টারের পাইলট। অন্য পাশে একটা মেয়ে হাতে একটা বেঢপ রিভলবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা ত্রাতিনা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়েই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। মুহূর্তে নীরার। মুখ থেকে রক্ত সরে যায়। সে হেলিকপ্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে কোনোভাবে বলল, তুমি?
হ্যাঁ, আমি। তুমি আমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ। তুমি আরো অবাক হবে, যদি শোন আমি একা নই। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে আমার মতো আরো দশ জন আছে। আমরা ক্লোন তাই আমাদের কোনো নাম থাকতে হয় না। কিন্তু আমরা সবাই মিলে আমার নাম দিয়েছি নায়ীরা।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নায়ীরা নামের মেয়েটি আসলে সে নিজে।
নায়ীরা একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জানতে যে তোমাকে ক্লোন করা হয়েছে?
না। নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীর আইনে কাউকে ক্লোন করা যায় না।
কিন্তু এরা করেছে। নায়ীরা হাত দিয়ে বেঁধে রাখা চার জনকে দেখিয়ে বলল, এরা বলেছে, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। এরা বলেছে কালো পোশাক পরা কমান্ডোরা এসে আমাকে কোনো কথা না বলার সুযোগ দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলবে।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা বলল, কিন্তু আমি তাদের বলেছি যে, তুমি আসবে। তুমি নিশ্চয়ই আসবে। আমাকে কেউ ডাকলে আমি যেতাম। তুমি নিশ্চয়ই আমার মতন, তাই না?
নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এখনো
নায়ীরা বাধা দিয়ে বলল, আমি কেন তোমার কাছে এসেছি সেটা তুমি এখনো শোন নি। সেটা শুনলে তুমি সেটাও বিশ্বাস করবে না।
তুমি কেন আমার কাছে এসেছ?
তুমি কি অবমানবদের কথা জান?
হ্যাঁ, জানি।
তারা ভুলভাবে নিজেদের বিবর্তন ঘটিয়েছে। হিংস্র বিকৃত বিকলাঙ্গ হয়ে গড়ে উঠেছে। মানুষকে ধ্বংস করার জন্য মানববিধ্বংসী অস্ত্র গড়ে তুলেছে। এখন আমাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তাই না?
হ্যাঁ।
নায়ীরা জোর করে হেসে বলল, তুমি কি জান এটা মিথ্যা? তুমি কি জান অবমানব বলে কিছু নেই? তারা সাধারণ মানুষ। নিরীহ মানুষ। অসহায় মানুষ। তুমি সেটা জান?
নীরা ত্রাতিনা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
কিন্তু এটা তো হতে পারে না, এটা অসম্ভব।
নায়ীরা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, এটা অসম্ভব।
কিন্তু এই মানুষগুলো সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর। তুমিও নিশ্চয়ই জান, আমি কখনো মিথ্যা বলব না। আমি তো আসলে তুমি।
হ্যাঁ, আমি জানি নায়ীরা। আমি জানি।
নায়ীরা একটু এগিয়ে এসে হঠাৎ করে কেমন জানি টলে উঠে কাছাকাছি একটা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলে নেয়। নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে?
আমি আসলে খুব অসুস্থ।
অসুস্থ! কী হয়েছে তোমার?
এরা বলেছে, আমি দুই সপ্তাহ পরে মারা যাব। কিন্তু আমি জানি, আমি দুই সপ্তাহ টিকে থাকব না। আমি টের পাচ্ছি, আমি তার অনেক আগেই মারা যাব। কিন্তু এখন আমার সেটা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই। কারণ আমি জানি, তুমি নিশ্চয়ই অবমানবদের রক্ষা করবে। করবে না?
আমার পক্ষে যেটুকু করার সেটা করব। নিশ্চয়ই করব।
আমি জানি, তুমি করবে। আমি হলে করতাম। তুমি আর আমি তো একই মানুষ, তাই না?
নায়ীরা চেয়ারটা ধরে খুব ধীরে ধীরে বসে। ফিসফিস করে বলে, আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে দাঁড়া করে রেখেছিলাম। আর পারছি না। আমি খুব ক্লান্ত। খুব অসুস্থ।
নীরা নায়ীরার কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করে, তোমার কী হয়েছে নায়ীরা?
অবমানদের হত্যা করার জন্য এরা আমার শরীরে লাখ লাখ কোটি কোটি ভাইরাসের জন্ম দিয়েছে। সেই ভাইরাসগুলো আমার শরীরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। নায়ীরা দুর্বলভাবে হেসে হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।
নীরা ত্রাতিনা ছুটে গিয়ে তাকে ধরে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। এই মেয়েটি সে নিজে। কৈশোরে সে ঠিক এরকম ছিল, সাহসী এবং তেজস্বী। মায়াময় এবং কোমল। গভীর আবেগে তার হৃদয় ছিল ভরপুর। কী আশ্চর্য! কৈশোরের সেই মেয়েটি আবার তার কাছে ফিরে এসেছে?
নায়ীরা নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, আমাকে কোনো মা জন্ম দেয় নি। আমার কোনো মা নেই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, মা থাকলে কেমন লাগে।