নায়ীরার কথা শুনে ফুলী-মা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, তুমি কি ভেবেছ আমরা তার চেষ্টা করি নি? কতবার চেষ্টা করেছি। আমাদের কত তরুণ-তরুণী টেহলিস শহরে যেতে চেষ্টা করেছে। কতবার সেই পাহাড় অতিক্রম করতে চেয়েছে। প্রতিবার তাদের ধরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। কেউ যেতে পারে নি। পৃথিবীর মানুষকে বোঝানো হয়েছে। আমরা অবমানব। আমরা ভয়ংকর প্রাণী। আমরা নিষ্ঠুর, আমরা হিংস্র, আমরা খুনি!
আমরা কি তাই বলে হাল ছেড়ে দেব? পৃথিবীর মানুষকে আমরা আর সত্যি কথা জানাতে চেষ্টা করব না?
কীভাবে চেষ্টা করবে?
নায়ীরা পকেট থেকে ছোট ইলেকট্রনিক বিকনটা বের করে দেখাল, এই যে দেখছ, এটা একটা ইলেকট্রনিক বিকন। এর সুইচটা অন করলে বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে কেউ আসবে উদ্ধার করতে। নিশ্চয়ই একটা হেলিকপ্টারে আসবে। তুমি এই গ্রামে তোমার সন্তানদের দিয়ে সেই হেলিকপ্টারটি দখল করিয়ে দিতে পারবে?
যদি দিই, তখন তুমি কী করবে?
আমি সেটা নিয়ে টেহলিস শহরে উড়ে যাব।
গিয়ে তুমি কী করবে?
আমি সবকিছু বলব।
ফুলী-মা আবার শব্দ করে হাসল। বলল, তুমি টেহলিস শহরে উড়ে যেতে পারবে কিনা আমি জানি না। যদি যেতেও পার, সেখানে কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না। সত্যি কথা বলতে কি, কেউ তোমার কথা শুনতেও রাজি হবে না।
হবে।
না, নায়ীরা। পৃথিবী খুব চমৎকার একটা জায়গা। কিন্তু তুমি যদি পৃথিবীতে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাক, তা হলে এই পৃথিবীর থেকে কঠিন জায়গা আর কিছু হতে পারে না। ফুলী-মা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা এখন ভুল সময়ে ভুল জায়গায় আছি। এখন তুমি একজন মানুষকেও তোমার কথা বিশ্বাস করাতে পারবে না।
পারব। পৃথিবীর সব মানুষ আমাকে অবিশ্বাস করলেও একজন কখনো আমাকে অবিশ্বাস করবে না।
সে কে?
তার নাম নীরা ত্রাতিনা।
কেন সে তোমার কথা অবিশ্বাস করবে না?
কারণ আমি তার ক্লোন।
নায়ীরা ব্যাকুল চোখে ফুলী-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করবে? আমার জন্য নয়, তোমার সন্তানদের জন্য। করবে?
ফুলী-মা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, নায়ীরা। আমি তোমাকে সাহায্য করব।
.
নায়ীরা একটা উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে প্রায় জনপঞ্চাশেক নারী-পুরুষ। তিহানের মা-যাকে গ্রামের সবাই ফুলী-মা ডাকে, সবাইকে এখানে একত্র হতে বলেছে। তিহানের মা এই গ্রামের সবারই মা, তার কথা কেউ কখনো ফেলতে পারে না। গ্রামের সবাই দেখেছে বিচিত্র পোশাকের কমবয়সী একটা মেয়ে এখানে এসেছে। কেন এসেছে তারা কেউ জানে না। পৃথিবী থেকে আগেও কখনো কখনো কোনো মানুষ এখানে এসেছে, কিন্তু সেটি কখনো তাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে নি। রূপসী এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই তাদের জন্য কোনো সৌভাগ্য বয়ে আনে নি, তাদের জন্য নিশ্চয়ই এক ভয়াবহ বিপদ বয়ে এনেছে। সেটি কত বড় বিপদ সেটাই তারা এখন জানতে চায়। যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা চাপা গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলছে, নায়ীরা হাত তুলতেই সবাই থেমে গেল।
নায়ীরা বলল, আমার নাম নায়ীরা। আসলে এটি আমার সত্যিকারের নাম না। আমার সত্যিকারের নাম নেই। আমি একটি ক্লোন। কোনো ক্লোনকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, তাই ক্লোনদের কোনো নাম থাকে না। পৃথিবীর মানুষ আমাকে কোনো নাম ধরে ডাকে না। আমাকে একটা নম্বর দিয়ে ডাকে। আমার নম্বর তিন শ নয়।
নায়ীরা সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, পৃথিবীর মানুষ যেরকম আমাকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না, ঠিক সেরকম তোমাদেরও মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না। তোমাদের তারা বলে অবমানব। পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে তারা বুঝিয়েছে তোমরা সত্যিকারের মানুষ নও। তোমরা হিংস্র, তোমরা খুনি, তোমরা অপরিণত বুদ্ধির মানুষ। তারা বলে, তোমরা তাদের ধ্বংস করার জন্য মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছ। তাই তোমাদের হত্যা। করতে হবে। তোমরা পৃথিবীর মানুষকে হত্যা করার আগে তারা তোমাদের হত্যা করবে।
তোমাদের হত্যা করার জন্য তারা আমাকে পাঠিয়েছে। আমার শরীরের ভেতরে আছে। একটি ভয়ংকর ভাইরাস। আমার রক্তে সেই ভাইরাস কিলবিল করছে। তারা আমাকে কেটে সেই রক্ত তোমাদের ওপর ছিটিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু সেটা ঘটে নি। আমি এখনো বেঁচে আছি এবং তোমরাও এখনো বেঁচে আছ। পৃথিবীর সেই অল্প কয়জন খারাপ মানুষ যখন সেটি জানবে, তারা আবার কাউকে পাঠাবে। সে যদি ব্যর্থ হয় তখন আবার কাউকে পাঠাবে। এখন তোমাদের বেঁচে থাকার একটিমাত্র উপায়।
কাঁপা গলায় একটি কিশোরী জানতে চাইল, কী উপায়?
নায়ীরা পকেট থেকে ছোট ইলেকট্রনিক বিকনটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বলল, এই যে আমার কাছে একটা ইলেকট্রনিক বিকন। অন করা মাত্রই এটা থেকে একটা সিগন্যাল বের হবে, তখন একটা হেলিকপ্টার আসবে উদ্ধার কাজে। সেই হেলিকপ্টারটি তোমাদের দখল করে দিতে হবে।
উপস্থিত নারী-পুরুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ একটি কথাও বলল না। নায়ীরা বলল, সেই হেলিকপ্টার নিয়ে আমি যাব টেহলিস শহরে, পৃথিবীর মানুষকে সত্য কথাটি বলতে। আমি যদি তাদের বলতে পারি, তা হলে তোমরা বাচবে। যদি না পারি, তোমরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তোমরা বলো, তোমরা কি একটিবার শেষ চেষ্টা না করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে চাও?