নৌকা থেকে নেমে তিহান সোজা হেঁটে যেতে থাকে। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন তাকে নিচু স্বরে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, তিহান তাদের কারো প্রশ্নের উত্তর দিল না। নায়ীরা চারপাশে তাকায়, ঘোট ঘোট শিশু, কিশোর-কিশোরী আর নানা বয়সের পুরুষ ও রমণী তাকে ঘিরে রেখেছে। তার শরীরের এক ফোঁটা রক্ত এদের সবাইকে হত্যা করে ফেলতে পারে! এর চেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা, এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?
একটা বড় খালি উঠোনের চারপাশে ছোট ছোট কয়েকটা মাটির ঘর। তিহান তার একটার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, মা।।
কয়েক মুহূর্ত পর ভেতর থেকে মধ্যবয়সী একজন মহিলা বের হয়ে আসে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে বয়সের বলিরেখা, রোদে পোড়া বাদামি চেহারা, শরীরে হাতে বোনা মোটা ধূসর কাপড়ের পোশাক। মহিলাটি ঘর থেকে বের হয়ে নায়ীরাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। একবার তিহানের দিকে, আরেকবার নায়ীরার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, তুমি কে, মেয়ে?
নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধূসর বিবর্ণ কাপড়ে ঢাকা মধ্যবয়স্ক এই মহিলাটির চোখ দুটোর দৃষ্টি কী তীব্র। মনে হয় তার শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে। মহিলাটি আবার জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
নায়ীরা কী বলবে বুঝতে পারল না। তিহান বলল, মা, তুমি যার কথা সব সময় বলল, এই মেয়েটি সেই মেয়ে।
মহিলাটি কেমন যেন চমকে উঠে ঘুরে নায়ীরার দিকে তাকায়। তীব্র স্বরে বলল, তুমি কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?
নায়ীরা ভাঙা গলায় বলল, আমি একা আর পারছি না। আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না।
তুমি কী বলতে চাও?
নায়ীরা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি কি তোমার সঙ্গে একা একা কথা বলতে পারি?
মহিলাটি কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। তুমি বস, তোমাকে আগে আমি কিছু খেতে দিই।
মহিলাটি ঘরের ভেতর থেকে ঘাসে বোনা একটি কার্পেট এনে বিছিয়ে দিয়ে বলল, বস।
নায়ীরা মাটির ঘরে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। সত্যিই সে ক্লান্ত। সত্যিই সে ক্ষুধার্ত। শুধু একজন মা হয়তো সন্তানের মতো কাউকে দেখে সেটা বুঝতে পারে। অন্যেরা পারে না। তার মা নেই। তার কখনো মা ছিল না। নীরা ত্রাতিনা নামে বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর শরীরের একটি কোষ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে তাকে ক্লোন করা হয়েছিল। একজন মানুষের শরীরের একটা কোষ নিয়ে যদি কাউকে ক্লোন করা হয় তা হলে কি তাকে মা বলা যায়? একজন মানুষের মা থাকা নিশ্চয়ই খুব বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। নিশ্চয়ই খুব মধুর অভিজ্ঞতা।
তিহানের মা মাটির একটা বাটিতে করে গরম সুপ নিয়ে আসে। সেই গরম সুপে চুমুক দিয়ে নায়ীরা মধ্যবয়স্ক মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, আমি তোমাকে কী বলে সম্বোধন করব?
এই গ্রামে সবাই আমাকে ফুলী-মা বলে ডাকে। এই গ্রামে সবাই আমার সন্তানের মতো।
আমিও তোমাকে ফুলী-মা বলে ডাকব?
ডাক।
আমি একজন ক্লোন। আমার কোনো মা ছিল না। আমি যদি কখনো কাউকে মা ডাকি সেটা হবে একটা মিথ্যাচার।
এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। এটি শুধু একটি সম্বোধন। ফুলী-মা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বলো, তুমি কেন আমার কাছে এসেছ।
আমি তোমাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
তুমি কেন আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছ?
তিহানের কথা থেকে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমার রক্তের ভেতরে রয়েছে তোমাদের সবাইকে হত্যা করার জন্য এক ভয়ংকর ভাইরাস।
ফুলী-মা কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা বলল, গত রাতে আকাশে আমার হাতের ধমনি কেটে তোমাদের ওপর এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল। ঘটনাক্রমে সেটি ঘটে নি।
ফুলী-মা বলল, আজ হোক, কাল হোক সেটা ঘটবে। পৃথিবীর মানুষ সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমাকে দিয়ে যদি না পারে তা হলে তারা অন্য কাউকে দিয়ে আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।
নায়ীরা বলল, আমাকে তুমি সেটা বুঝিয়ে দেবে?
তুমি কী বুঝতে চাও মেয়ে?
কেমন করে এটা হতে পারে?
আমি ছোট থাকতে যখন ইতিহাস পড়েছি তখন দেখেছি, অসংখ্যবার পৃথিবীতে এ ঘটনা ঘটেছে। মানুষ নিজেদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছে, তারপর শক্তিমান মানুষ দুর্বল মানুষকে হত্যা করেছে।
নায়ীরা বলল, কিন্তু কেন মানুষের বিভাজন হবে? আমি কেন ক্লোন, অন্যেরা কেন মানুষ? আমরা সবাই কেন মানুষ না? তোমরা কেন অবমানব, অন্যেরা কেন মানব? সবাই কেন মানব না?
মহিলা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এই আলোচনা থাক মেয়ে। আমরা জানতাম, মৃত্যু আসছে। চারপাশে পাহাড়, এক পাশে নদী, বিশাল এই এলাকায় আমরা আটকা পড়া কিছু মানব। পৃথিবীর মানুষের ভাষায় অবমানব! ভালোই হল, তুমি সঙ্গে করে মৃত্যুকে নিয়ে এসেছ। কখন সেই ভয়ংকর সময় আসবে এখন আমাদের সেটা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমরা ভেবেচিন্তে আমাদের সময় ঠিক করে নেব।
না। নায়ীরা মাথা নাড়ল, না, ফুলী-মা, সেটা হতে পারে না।
কী হতে পারে না?
এভাবে তোমাদের সবার মৃত্যু হতে পারে না।
নায়ীরা, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
শোন ফুলী-মা, পৃথিবীর মানুষ তোমাদের কথা জানে না। যেটুকু জানে ভুলভাবে জানে, বিকৃতভাবে জানে। আমি তাদের ভুল ভাঙাতে চাই, সত্যি কথা জানাতে চাই।