এরপর যে ঘটনাটি ঘটবে সেটি কেউ চিন্তাও করতে সাহস পায় না।
কিছুক্ষণের মাঝেই মহাকাশযানের সব ক্রু গ্রহাণু টোরকার কথা জেনে গেল, মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন জরুরিভাবে সবাইকে তার কেবিনে ডেকে পাঠাল। গ্রহাণুটা পৃথিবীকে আঘাত করলে কী হতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পদার্থবিজ্ঞানী রিশি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, টোরকা গ্রহাণুটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঘণ্টায় এক শ বিশ হাজার কিলোমিটার বেগে আঘাত করবে।
উপস্থিত বেশ কয়েকজন বিস্ময়ে শিস দেবার মতো একটা শব্দ করল। রিশি মাথা নেড়ে বলল, গ্রহাণুটার আকার বারো কিলোমিটার। এটা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে যাবে এবং কিছু বোঝার আগে, প্রায় চোখের পলকে, পৃথিবীতে আঘাত করবে। শেষবার এরকম একটা উল্কা আঘাত করেছিল জনমানবহীন সাইবেরিয়াতে তাই কোনো প্রাণহানি হয় নি। কিন্তু এই গ্রহাণুটা আঘাত করবে এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল এলাকায়। গ্রহাণুটা যখন পৃথিবীতে আঘাত করবে সেটা পৃথিবীর উপরের স্তর কয়েক কিলোমিটার ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে। সেই ভয়ংকর বিস্ফোরণটি হবে কয়েক হাজার নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণের সমান। মুহূর্তে প্রায় অর্ধবিলিয়ন মানুষ মারা যাবে।
যারা উপস্থিত ছিল তারা আবার শিস দেবার মতো একটা শব্দ করল। রিশি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। সেটা হচ্ছে স্ক। এই বিস্ফোরণে পাথর ধুলাবালি বিদ্যুৎগতিতে উপরে উঠে যাবে। কেন জান?
নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, কেন?
কারণ এই গ্রহাণুটা যখন পৃথিবীর দিকে ছুটে যাবে তখন তার পেছনের সব বাতাসকে সরিয়ে নেবে, পেছনে থাকবে একটা শূন্যতা, সেই শূন্য গহ্বর দিয়ে ধুলাবালি পাথর ধোঁয়া আবর্জনা সবকিছু উঠে আসবে। তারপর সেটা ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীর আকাশে। আমাদের কেউ যদি তখন মহাকাশের এই স্টেশনে থাকি তা হলে আমরা দেখব কালো ধোঁয়ায় পৃথিবীটা ঢেকে যাচ্ছে। গ্রহটিকে আর নীল দেখাবে না, এটাকে দেখাবে ধূসর।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে দিন-রাতের কোনো পার্থক্য থাকবে না, পুরোটাই হবে কালো রাত। কুচকুচে অন্ধকারে সবকিছু ঢাকা থাকবে। হিমশীতল ঠাণ্ডায় পৃথিবী স্থবির হয়ে যাবে। আকাশ থেকে কালো ধুলাবালি পৃথিবীতে পড়তে থাকবে, পুরো পৃথিবী ঢেকে। যাবে কালো ধুলার স্তরে। প্রথমে যারা মারা যায় নি তখন তারা মারা পড়তে শুরু করবে।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করল। জীববিজ্ঞানী কিরি বলল, হ্যাঁ আমার ধারণা পৃথিবীর জীবিত প্রাণীর প্রায় নিরানব্বই শতাংশ মারা যাবে। সমুদ্রের পানি ধুলায় ঢেকে যাবে, জলজ প্রাণীরা নিশ্বাস নিতে পারবে না। গাছপালা কীটপতঙ্গ মারা যাবে প্রচণ্ড শীতে। পশুপাখি মারা যাবে না খেতে পেয়ে। তাদের খেয়ে বেঁচে থাকত যে প্রাণী তখন মারা যাবে সেই। প্রাণী! ফুড চেইন ধরে একটি একটি প্রজাতি ধ্বংস হতে শুরু করবে। পরবর্তী এক বছরে পুরো পৃথিবী প্রায় প্রাণহীন একটা গ্রহে পাল্টে যাবে।
রিশি বলল, হ্যাঁ। এক দুইজন মানুষ নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকবে। তারা আবার একেবারে গোড়া থেকে পৃথিবীর সভ্যতা শুরু করবে!
রিশির কথা শেষ হবার পরও সবাই কেমন যেন হতচকিতের মতো বসে থাকে, পুরো বিষয়টি যেন এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সিকিউরিটি অফিসার থুল কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে গেল। ঠিক তখন একটা হাসির শব্দ শোনা যায়-সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হাসছে।
থুল একটু ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, কী হল? তুমি হাসছ কেন?
তোমাদের সবাইকে দেখে।
আমাদের মাঝে হাসির ব্যাপারটা কী?
তোমাদের চেহারা দেখেই হাসি পাচ্ছে। তাকিয়ে দেখ সবাইকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে টোরকা গ্রহাণুটা সত্যি সত্যি পৃথিবীকে আঘাত করে ফেলেছে। সত্যি সত্যি পৃথিবীর সব মানুষ মরে ভূত হয়ে গেছে। মনে রেখ এখনো ব্যাপারটা ঘটে নি এবং আমরা সেটা ঘটতেও দেব না।
কেউ কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। নীরা ত্রাতিনা বলল, আমরা এখান থেকে একটা মিসাইল দিয়ে গ্রহাণুটাকে আঘাত করব। নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে টোরকাকে টুকরো টুকরো করে দেব।
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমাদের কাছে পৃথিবী থেকে সেরকম একটা নির্দেশ এসেছে।
কাজেই তোমরা সবাই এরকম প্যাচার মতো মুখ করে থেকো না। তোমাদের দোহাই লাগে-শুধু শুধু কেউ মুখ ভোঁতা করে বসে থাকলে দেখতে খুব খারাপ লাগে!
নীরা ত্রাতিনার কথা শুনে এবারে বেশ কয়েকজন সহজ গলায় হেসে উঠল। রিশি বলল, নীরা ঠিকই বলেছে। এই বিদঘুটে গ্রহাণুটা তো সত্যি সত্যি পৃথিবীকে আঘাত করে নি! আমরা এটাকে তার আগেই ধ্বংস করব।
থুল হাত উঁচু করে বলল, অবশ্যই ধ্বংস করব।
একসাথে এবারে অনেকে হাত তুলে প্রায় স্লোগানের ভঙ্গিতে বলল, অবশ্যই ধ্বংস করব।
.
একটা স্কাউটশিপে করে ফ্লাইট ক্যাপ্টেন রিশান এবং মহাকাশচারী শুরার গ্রহাণু টোরকার কাছে যাবার কথা ছিল, কিন্তু নীরা ত্রাতিনা বলল সেও যেতে চায়। কাজটি বিপজ্জনক তাই কেউ যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায় তাকে অগ্রাধিকার দেবার নিয়ম। নীরা ত্রাতিনার বয়স তুলনামূলকভাবে কম হলেও সে প্রথম শ্রেণীর মহাকাশচারী। তাই পৃথিবী থেকে তার অনুমতি পেতে সমস্যা হল না। স্কাউটশিপটি ছোট, সেখানে তিন জন যাওয়া সহজ নয় তাই শেষ পর্যন্ত। রিশান এবং মহাকাশচারী শুরার পরিবর্তে নীরা ত্রাতিনাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।