নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তিহান বলল, আমি যাই।
তুমি কোথায় যাবে?
আমি আমার গ্রামে যাব। গিয়ে সবাইকে বলব আমরা যে শেষ সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেই সময়টা চলে এসেছে।
তোমার কি ভয় করছে তিহান?
না। আমার ভয় করছে না। একটু দুঃখ লাগছে, কিন্তু ভয় করছে না। তিহান কয়েক মুহূর্ত নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বিদায়। তারপর হাতের মুখোশটা সে মাথায়। পরে নিল। মুহূর্তে তাকে দেখাতে লাগল একটা ভয়ংকর দানবের মতো। তিহান ঘুরে দাঁড়াল, তারপর পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতে ব্রু করল। নায়ীরা হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, তিহান দাঁড়াও। শোন।
তিহান তার ভয়ংকর মুখ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, কী হল?
আমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?
কোথায়?
তোমাদের গ্রামে।
কেন?
তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে।
তিহান কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর মুখ থেকে ভয়ংকর মুখোশটা খুলে বলল, এস।
তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর। আমি একটা জিনিস নিয়ে নিই।
কী জিনিস?
একটা বিকন। এটা চালু করলে বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করতে আসবে।
কাকে উদ্ধার করতে আসবে?
আমাকে না। রিশিকে। যাকে আমি এখানে কবর দিয়েছি।
তিহান কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা গ্লাইডারের ড্রয়ার খুলে ঘোট ইলেকট্রনিক বিকনটা খুঁজে বের করে নিজের পকেটে নিয়ে নেয়। তারপর তিহানের কাছে এসে বলল, চল যাই।
চল।
তিহান, শুধু একটা বিষয়ে খুব সাবধান।
সেটা কী?
আমার রক্তে কিলবিল করছে এমন একটা ভাইরাস যেটা আমাকে এত সহজে হত্যা। করতে পারবে না, কিন্তু তোমাদের আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে শেষ করে দেবে। কাজেই খুব সাবধান, যেন কোনোভাবে আমার শরীর কেটে রক্ত বের হয়ে না যায়। তা হলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তিহান কোনো কথা না বলে একটু হাসার চেষ্টা করল। নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?
কারণ কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। পৃথিবীর মানুষ তোমাকে দিয়ে যদি আমাদের শেষ করতে না পারে, তা হলে আরেকজনকে পাঠাবে। তাকে দিয়ে সম্ভব না হলে আরেকজনকে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, কাজেই এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আজ হোক কাল হোক, আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব নায়ীরা।
নায়ীরা কিছুক্ষণ তিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি দুঃখিত তিহান।
তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই।
আমি জানি না, এটা থেকে সান্ত্বনা পাওয়ার কোনো যুক্তি আছে কিনা আমার শরীরকে ভাইরাস তৈরির জন্য ব্যবহার করেছে বলে আমার আয়ু আর মাত্র দুই সপ্তাহ।
আমি দুঃখিত নায়ীরা।
তোমারও দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই তিহান।
কথাটি হাসির কথা নয় কিন্তু কেন জানি দুজনেই একসাথে একটু হেসে ফেলল।
বনের ভেতর দিয়ে নায়ীরা তিহানের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যেতে থাকে। দুই পাশে গাছে বুনো ফুল, বাতাসে ফুলের গন্ধ। পাখি ডাকছে, কাঠবিড়ালী গাছে ছুটোছুটি করছে। নায়ীরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হয় না প্রকৃতির এত কাছাকাছি যে মানুষগুলো বেঁচে আছে, কী আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।
বুনো পথ শেষ হয়ে হঠাৎ একটা খোলা প্রান্তর শুরু হয়ে গেল। লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে দুজন হেঁটে যায়। প্রান্তরের শেষে একটা নদী। একটা গাছের নিচে ছোট একটা নৌকা বাঁধা। একটা গাছের ভেতরটুকু খোদাই করে নৌকাটি তৈরি করা হয়েছে। দুজন কষ্ট করে বসতে পারে। তিহান নৌকাটা খুলে নায়ীরাকে বলল, ওঠ।
নায়ীরা নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা ভিজিয়ে নৌকায় উঠে বসে। তিহান নৌকাটাকে মাঝনদীর দিকে ধাক্কা দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল। নদীর স্রোতে নৌকাটা তরতর করে। এগোতে থাকে, তিহান বৈঠাটাকে হালের মতো ধরে রেখেছে। তিহান হাত দিয়ে নদীর পানি তুলে এক চুমুক খেয়ে বলল, সোতের টানে যাচ্ছি, দেখতে দেখতে পৌঁছে যাব।
তোমার গ্রাম এখান থেকে কত দূর?
তিহান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, এখন আমাদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর কোনো অর্থ নেই। একসময় আমরা মিটার-কিলোমিটার ব্যবহার করেছি। এখন আর প্রয়োজন হয় না। দূরত্ব হচ্ছে কাছে কিংবা দূরে। ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড বলেও আমাদের কিছু নেই। সময় এখন হচ্ছে সকাল-দুপুর আর সন্ধ্যা!
নায়ীরা আর কোনো কথা বলে না। দেখতে দেখতে নৌকাটা বুনো অঞ্চল পার হয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি আসতে থাকে। নদীর পাশে হঠাৎ করে একটা-দুটো গ্রাম দেখা যায়। মাটির ঘর, ঘাসের ছাদ। নদীর তীরে উদোম গায়ে শিশুরা খেলছে। শক্ত-সমর্থ নারীরা শস্য বাছাই করছে। পুরুষ মানুষেরা মাঠে কাজ করছে। দেখে মনে হয় কয়েক হাজার বছর আগের একটা দৃশ্য। আধুনিক সভ্যতার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু পুরো দৃশ্যটাতে এক ধরনের আশ্চর্য কোমল শান্তির ছাপ খুব স্পষ্ট। নায়ীরা সেদিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ একটু বিভ্রান্ত হয়ে যায়, পৃথিবীর সভ্যতা সত্যিই কি ঠিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে?
তিহান যখন তার গ্রামে পৌঁছল, তখন সূর্য ঢলে পড়ে বিকেল হয়ে এসেছে। নদীর ঘাটে নৌকাটা বেঁধে তিহান নদীর তীরে নেমে এল। স্বচ্ছ নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে নায়ীরাও নেমে আসে। গ্রামের ছোট ছোট শিশুরা নদীর ঘাটে ভিড় করেছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু নারী-পুরুষ এগিয়ে এসেছে। এখানকার মানুষের সঙ্গে নায়ীরার চেহারা আর পোশাকের পার্থক্যটুকু খুব স্পষ্ট।