নায়ীরা আতঙ্কে চোখ বন্ধ করল। এই ভয়ংকর প্রাণীটির দিকে সে তাকাতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না। নারীরা চোখ বন্ধ করে হাঁটু গেড়ে বসে রইল। প্রাণীটি তাকে আঘাত করুক, তাকে হত্যা করুক। সে রিশির পাশে প্রাণ হারিয়ে শুয়ে থাকবে। কিন্তু সে আর চোখ খুলবে না। কিছুতেই চোখ খুলবে না।
তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
অবমানবটির কথা শুনে নায়ীরা চমকে ওঠে। ভয়ংকর চেহারার এই প্রাণীটির গলার স্বর ভরাট এবং স্পষ্ট। উচ্চারণ একটু অন্যরকম, কিন্তু কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। নায়ীরা দু হাতে মুখ ঢেকে রইল, তার কথা বলার শক্তি নেই।
চোখ তুলে তাকাও মেয়ে।
নায়ীরা ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকায়। ভয়ংকর প্রাণীটি তার দিকে এগিয়ে আসে, তারপর গলার কাছে হাত দিয়ে নিজের মুখোশটি খুলে নেয়। মুখোশের নিচে অনিন্দ্যসুন্দর একজন তরুণের মুখ, নীল চোখ, খাড়া নাক, কুচকুচে কালো চুল। তরুণটি একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি কি আমার মুখোশ দেখে ভয় পেয়েছ? আমি দুঃখিত। খুব দুঃখিত।
নায়ীরা কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে এই অনিন্দ্যসুন্দর তরুণের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ধাতস্থ হতে একটু সময় নেয়। বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি মুখে এই মুখোশটি পরেছিলে কেন?
তরুণটি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, এখানে কেউ নেই। আমি একা। মানুষ একা থাকলে অদ্ভুত অনেক কিছু করে। তা ছাড়া
তা ছাড়া কী?
আমি হরিণ কিংবা একটা পাহাড়ি ছাগল শিকার করতে এসেছি।
শিকার? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, আমি জানতাম মানুষ প্রাচীনকালে শিকার করত। এখনো করে?
সুদর্শন তরুণটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমাদের মাঝে মাঝে করতে হয়। তখন আমি এখানে আসি।
ও। আচ্ছা।
শিকার করার সময় আমি এই মুখোশটা মুখে পরে নিই।
কেন?
হরিণ কিংবা পাহাড়ি ছাগলের মতো সুন্দর এক প্রাণীকে হত্যা করতে আমার খুব খারাপ লাগে। তখন আমি মুখে এই মুখোশটা পরে নিয়ে ভান করি যে আমি আমি না। আমি অন্য কেউ। একটা দানব।
নায়ীরা একটু অবাক হয়ে এই বিচিত্র তরুণটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই তরুণটি কি অবমানব? অবমানব সম্পর্কে কত ভয়ংকর কথা শুনেছে কিন্তু তরুণটিকে তো মোটেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। একটু বিচিত্র কিন্তু মোটেও ভয়ংকর নয়।
তরুণটি এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর সরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি কে? তুমি কোথা থেকে এসেছ?
নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি তোমার এ প্রশ্নের উত্তর কেমন করে দেব জানি না। কারণ এর কোনো উত্তর নেই। আমি কেউ না। আমার কোনো নাম পর্যন্ত নেই। আমি নিজের জন্য একটা নাম ঠিক করেছি, সেই নামে আমাকে কেউ ডাকে না। একজন ডাকত, তাকে আমি এখানে কবর দিয়েছি।
তরুণটি বিস্মিত হয়ে বলল, এখানে কবর দিয়েছ?
হ্যাঁ।
তরুণটি শিস দেওয়ার মতো এক ধরনের শব্দ করে বলল, আমি দুঃখিত যে তোমার একজন সঙ্গী মারা গেছে। সে কেমন করে মারা গেল?।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, পুরো বিষয়টি আমি যদি তোমাকে খুলেও বলি তুমি সেটা বিশ্বাস করবে না। আমার কথা থাকুক। তুমি কে?
আমার নাম তিহান।
তিহান?
হ্যাঁ।
আমার নাম নায়ীরা।
তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম নায়ীরা। তরুণটি একটু এগিয়ে এসে হাত মেলানোর জন্য তার হাতটি বাড়িয়ে দেয়।
নায়ীরা কিছুক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়া হাতটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার সঙ্গে হাত মেলানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
কেন?
কারণ আমার শরীরে ভয়ংকর একটা ভাইরাস আছে। এই ভাইরাস দিয়ে তোমাদের সবাইকে হত্যা করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে। তোমাকে স্পর্শ করলে যদি তোমার শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়?
নায়ীরা ভেবেছিল, তার এ কথা শুনে তিহান নামের এই তরুণটি খুব বিস্মিত হবে।
কিন্তু তরুণটি বিস্মিত হল না। এগিয়ে দেওয়া হাত সরিয়ে নিয়ে শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, আমার কথা শুনে তুমি অবাক হও নি?
তিহান মাথা নাড়ল, না।
কেন নয়?
কারণ আমরা জানি, এরকম একটা কিছু হবে।
তোমরা জান? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, তোমরা কেমন করে জান?
আমরা জানি পৃথিবীর মানুষ আমাদের অবমানব বলে। তারা আমাদের নিয়ে অনেক রকম পরীক্ষা করে।
তোমাদের নিয়ে অনেক পরীক্ষা করে?
হ্যাঁ। আমার মায়ের কাছে আমরা শুনেছি পৃথিবীর মানুষেরা একসময় আমাদের নিয়ে জেনেটিক এক্সপেরিমেন্ট করেছে। তখন এখানে অনেক বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছে। তাদের হাতে সাতটি আঙুল। কপালে বাড়তি চোখ। উত্তরের একটা গ্রামে একটা শিশুর দুটি মাথা ছিল।
এখন সেরকম শিশুর জন্ম হয় না?
না।
কেন?
মনে হয় তারা সেই এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করেছে। এখন আমাদের নিয়ে অন্য এক্সপেরিমেন্ট করে।
কী এক্সপেরিমেন্ট?
আমাদের সব পাওয়ার স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের সবকিছু তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এখন প্রাচীন মানুষের মতো থাকি। চাষ করি। শিকার করি। গাছের বাকলের পোশাক পরি।
নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, ও।
আমার মা বলেন, আমরা আসলে একটা ল্যাবরেটরিতে আছি। আমাদের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে পৃথিবীর মানুষ গবেষণা করে। মানুষের ওপর গবেষণা। সমাজের ওপর গবেষণা।
নায়ীরা কী বলবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তিহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ভয়ংকর কোনো রোগ এসে আমাদের ওপর ভর করে। আমাদের অনেক মানুষ তখন মারা যায়। আমার মা বলেছে, পৃথিবীর মানুষ একটা রোগ বের করার জন্য গবেষণা করছে, যে রোগে আমাদের সব মানুষ একসাথে মরে যাবে।