নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসে। এই গ্লাইডারটাকে এখন সে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে ভাসিয়ে নেওয়ার কথা। তারপর এটাকে ঠিক জায়গায় সে নিচে নামিয়ে আনবে, ঠিক যেভাবে নামিয়ে আনার কথা। তারপর সে যাবে টেহলিস শহরের দিকে, ঠিক যেভাবে তার যাওয়ার কথা। হতে পারে সেটি অসম্ভব, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তার শরীরে মৃত্যু বাসা বেঁধেছে, তার আর কোনো কিছুতে ভয় পাওয়ার নেই। সে আর কোনো কিছুতে ভয় পাবে না।
.
দীর্ঘ একটি রাত শেষ হয়ে যখন পূর্ব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে, উঁচু গাছের কচি পাতায় যখন ভোরের সূর্যের সোনালি রোদ স্পর্শ করেছে, তখন অতিকায় একটি ফিনিক্স পাখির মতো ধবধবে সাদা গ্লাইডারটি নিঃশব্দে নিচে নেমে এল। চাকার ওপর ভর করে। সোজা সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে গিয়ে একসময় সেটি থেমে যায়।
নায়ীরা তার ককপিট থেকে নিচে নেমে আসে। সে এখন অবমানবের এলাকায়। হয়তো এই মুহূর্তে কোনো একজন অবমানব তার ভয়ংকর বিকৃত চেহারা নিয়ে, তার তিনটি চোখ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো হাতের সাত আঙুল দিয়ে ধরে রাখা কোনো ভয়ংকর অস্ত্র তার দিকে তাক করে রেখেছে, অদৃশ্য কোনো বুলেট তার মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে দেবে, নিজের অজান্তে তার শরীরের লক্ষ-কোটি ভাইরাস কিলবিল করে তাদের ধ্বংস করার জন্য ছড়িয়ে পড়বে। নায়ীরা কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো বুলেট তার মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে দিল না, ভয়ংকর অস্ত্র হাতে দুই মাথার কোনো দানবও ছুটে এল না। নায়ীরা তখন পেছনের ককপিটে গিয়ে ভেতরে তাকাল। সিটবেল্টে বাঁধা রিশির মৃতদেহ রক্তশূন্য এবং বিবর্ণ। ঠোঁট দুটো নীল, চোখ আধখোলা। রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমি দুঃখিত রিশি। আমি খুব দুঃখিত।
রিশি বলেছিল তার জ্যাকেটের পকেটে কিছু একটা আছে, সে যেন সেটা দেখে। নায়ীরা সাবধানে জ্যাকেটের পকেটে হাত দেয়, সেখানে দুমড়ানো একটা খাম। নায়ীরা খামটি খুলে দেখে ভেতরে খবরের কাগজের এক টুকরো কাগজ। সেখানে ছোট একটা খবর, নায়ীরা ফিসফিস করে সেটা পড়ল।
মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত
কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনাকে (৪২) সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, নীরা ত্রাতিনা একাধিকবার দুঃসাহসিক মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়েছেন এবং মহাকাশে নিউক্লিয়াসের বিশ্লেষণ সম্পর্কে তার মৌলিক গবেষণা কাজ রয়েছে। যৌবনে মহাকাশে এক দুর্ঘটনায় তার প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুর পর তিনি তার একাকী নিঃসঙ্গ জীবন মহাকাশ গবেষণায় অতিবাহিত করেন।
ছোট খবরটির ওপরে বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার একটি ছবি। নায়ীরা নিশ্বাস বন্ধ করে বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। ছবিটি তার নিজের। তার থেকে একটু বয়স বেশি, কিন্তু মানুষটি যে সে নিজে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার কালো চুল, তার চোখ, ঠোঁটের কোনায় তার হাসি। রিশি টেবিলের ওপর থেকে একবার তার একটি চুল তুলে নিয়েছিল, সেখান থেকে তার ডিএনএ প্রোফাইল বের করে নিশ্চয়ই নীরা ত্রাতিনাকে খুঁজে বের করেছে।
কী আশ্চর্য! মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনা কি জানে তার ক্লোন করা হয়েছে? সে কি জানে তার দুঃসাহসী অস্তিত্বকে এখন ল্যাবরেটরিতে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়? যদি জানত তা হলে সে কী করত?
নায়ীরা কাগজের টুকরোটি পকেটে রেখে সাবধানে রিশির দেহটি মুক্ত করে নিচে নামিয়ে আনে। এই মানুষটির মৃতদেহ একটি সম্মানজনক শেষকৃত্য দাবি রাখে। একজন মানুষের মৃতদেহকে কেমন করে সমাহিত করতে হয় সে জানে না। তবু সে চেষ্টা করবে। মাটিতে গর্ত করে সে রিশিকে সেখানে শুইয়ে দেবে। সমাধির ওপরে একটি পাথর রেখে। সেখানে লিখে দেবে, রিশি : পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।
নায়ীরা গ্লাইডার থেকে একটা শাবল নিয়ে ছায়াঢাকা একটি সুন্দর জায়গায় মাটি কাটতে থাকে। সে আগে কখনো মাটি কাটে নি, মাটি কাটতে এত কষ্ট সে জানত না। নিঃশব্দে সে শাবল দিয়ে গর্ত করতে থাকে, তাকে খুব সাবধান থাকতে হবে যেন কোনোভাবে শরীরের কোথাও কেটে না যায়। শরীর থেকে যেন এক ফোঁটা রক্তও বের হয়ে না আসে একটি প্রজাতিকে সে ধ্বংস করতে চায় না। সে প্রজাতি যত ভয়ংকর প্রজাতিই হোক।
রিশির দেহটিকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার আগে নায়ীরা তাকে শেষবারের মতো স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, রিশি। বিদায়। তুমি কোথায় গিয়েছ আমি জানি না। তবে সেখানে আমি আসছি। দু সপ্তাহের মধ্যেই আছি।
পুরো দেহটি মাটি দিয়ে ঢেকে সে যখন উঠে দাঁড়াচ্ছে ঠিক তখন তার নজরে পড়ল গাছের নিচে এক জোড়া পা। কোনো একজন মানুষ নিঃশব্দে তাকে দেখছে। নায়ীরা খুব ধীরে ধীরে চোখ তুলতে থাকে—পা, দেহ এবং সবশেষে মাথা। নায়ীরা এর আগে অনেকবার অবমানবের বর্ণনা শুনেছে, কিন্তু নিজের চোখে প্রথমবার একজন অবমানব দেখে নায়ীরা আতঙ্কে শিউরে ওঠে। বিকৃত কুঞ্চিত ভয়ংকর একটি মুখমণ্ডল, দুটি চোখ ঠেলে বের হয়ে এসেছে। নাক নেই, সেখানে গলিত একটি গর্ত। ঠোঁটহীন একটি মুখ, ধারালো দাঁতের পেছনে লকলকে লাল জিব। মুখ থেকে আঠালো লালা ঝরছে। তীব্র ক্রুর দৃষ্টিতে কুৎসিত অবমানবটি তার দিকে তাকিয়ে আছে।