কী কাজ?
তুমি এই ককপিটে বস। আমি পেছনে তোমার ককপিটে বসি।
কিন্তু যদি হঠাৎ করে কিছু হয়?
কী আর হবে? রিশি শব্দ করে হেসে বলল, এটা একটা গ্লাইডার, গাছের পাতা যেরকম বাতাসে ভাসতে ভাসতে নামে, এটাও সেরকম ভাসতে ভাসতে নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে কিছু হওয়ার নেই।
ঠিক আছে, নায়ীরা খুশি হয়ে বলল, আমি হলে তোমার ককপিটে বসছি। তুমি আমার ককপিটে যাও।
রিশি ককপিট থেকে বের হয়ে ফিউজলেজের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে নায়ীরার ককপিটে গিয়ে বসে যায়।
.
ককপিটে বসে নায়ীরা গ্লাইডারটিকে কখনো ওপরে কখনো নিচে নামিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। বাতাসের প্রবাহের কারণে কখনো কখনো গতিবেগের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল, নায়ীরা সেটাও ঠিক করে নিতে শিখেছে। ককপিটে বসে সে দেখতে দেখতে প্রায় দুই শ কিলোমিটার উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। বাইরে নিশুতি রাত। চাঁদটি পশ্চিম দিকে খানিকটা ঢলে পড়েছে। জ্যোৎস্নার নরম আলোয় গ্লাইডারটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো দেখায়। নিচে, বহু নিচে অবমানবেরা হিংস্র চোখে হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নায়ীরা। একবার পেছনে ফিরে রিশিকে দেখার চেষ্টা করল। রিশি ককপিটে শান্তভাবে বসে আছে, এই কনকনে শীতেও তার ককপিটের ঢাকনা খোলা, বাতাসে তার চুল উড়ছে। নায়ীরা রিশিকে উদ্দেশ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ছোট একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল-সঙ্গে সঙ্গে রিশি ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে। নায়ীরা শুনতে পেল রিশি একটা কাতর আর্তনাদের মতো শব্দ করেছে। নায়ীরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, রিশি, কী হয়েছে রিশি?
রিশি তার কথার উত্তর দিল না। নায়ীরা আবার ডাকল, রিশি। রিশি-
রিশি এবারেও তার কথার উত্তর দিল না, শুধু একটা চাপা আর্তনাদের মতো শব্দ করল। এক মুহূর্তের জন্য ভয়ে আতঙ্কে নায়ীরার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল, অনেক কষ্টে সে নিজেকে শান্ত করল। ফিউজলেজের ওপর উঠে সে রিশির ককপিটে এগোতে এগোতে বলল, আমি আসছি বিশি।
গ্লাইডারটি দুলছে, সামনের ককপিটটি সম্ভবত কখনো খালি রাখার কথা নয়, কিন্তু এখন সেটি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। পেছনের ককপিটের কাছাকাছি গিয়ে নায়ীরা আবার ডাকল, রিশি।
ককপিটের ভেতর থেকে রিশি গোঙানোর মতো শব্দ করে বলল, কাছে এস না নায়ীরা।
কেন?
এই ককপিটটাতে বুবি ট্র্যাপ বসানো।
কী বসানো?
বুবি ট্র্যাপ। আমি মারা যাচ্ছি নায়ীরা।
নায়ীরা আর্তনাদ করে বলল, কী বলছ তুমি?
গ্লাইডারটি খুব খারাপভাবে দুলছে, তার মধ্যেই নায়ীরা আরো একটু অগ্রসর হয়ে গেল। রিশি চাপা স্বরে বলল, খবরদার নায়ীরা, কাছে এস না খবরদার।
জ্যোৎস্নার আলোয় নারীরা অস্পষ্টভাবে রিশিকে দেখতে পায়। তার শরীরে ছোপ ছোপ কালো রঙ। আসলে রঙটি কালো নয়, সেটা যে রক্তের ছোপ সেটা বুঝতে নায়ীরার একটুও দেরি হয় না।
তোমার এখানে থাকার কথা ছিল। রিশি ফিসফিস করে বলল, এখানে তোমাকে হত্যা করার কথা ছিল। তুমি বেঁচে গেছ নায়ীরা-।
নায়ীরা আর্তনাদ করে বলল, না। আমি বাঁচতে চাই না –
নায়ীরা, তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমাকে টেহলিস শহরে যেতে হবে। আমার জ্যাকেটের পকেটে-
রিশি তার কথা শেষ করতে পারল না, জ্যোত্সর আবছা আলোতে হঠাৎ বিদ্যুঝলকের মতো কিছু একটা রিশির দিকে ছুটে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে, সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ করে হঠাৎ রিশি নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
নায়ীরা ফিউজলেজে শুয়ে আকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে ডাকল, রিশি, রিশি। আমার রিশি!
মাটি থেকে পাঁচ হাজার মিটার ওপরে গ্লাইডারটি বিপজ্জনকভাবে দুলতে দুলতে নিচে নেমে আসতে থাকে। তার ফিউজলেজে শুয়ে পনের বছরের কিশোরী একটা মেয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। পৃথিবীর কোনো মানুষ সেই মেয়েটির অসহায় কান্নার শব্দ শুনতে পায় না।
.
নায়ীরা ককপিটে পাথরের মতো বসে আছে। গ্লাইডারটি খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে, সেটাকে ওপরে নেওয়া দরকার, কিন্তু নায়ীরা তার চেষ্টা করে না। দক্ষিণ দিক থেকে একটা বাতাস এসে গ্লাইডারটাকে তার গতিপথ থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে, নায়ীরা সেটাও ঠিক করার চেষ্টা করল না-এখন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। ঠিক তখন খুট করে ককপিটে একটা শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল প্যানেলের ভিডিও মনিটরটি জ্বলে ওঠে। রিশি বলেছিল সে এটা চালু করার চেষ্টা করেছিল লাভ হয় নি। এখন নিজে নিজেই এটা চালু হয়েছে। সেখানে প্রথমে কয়েকটি সংখ্যা ভেসে আসে, তারপর সংখ্যাগুলো সরে গিয়ে একটা নীল আলো দেখা দেয়। প্রথমে এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ এবং তারপর হঠাৎ একজন মানুষের। ছবি ভেসে আসে। নায়ীরা মানুষটিকে চিনতে পারে, বিজ্ঞান কেন্দ্রের পরিচালক রুবা।
রুবা তার কঠিন মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, যদি সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো ঘটে থাকে, তা হলে রিশি তুমি সামনের ককপিটে বসে আছ এবং খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছ পেছনের ককপিটে এইমাত্র কী ঘটে গেল। যদি তোমাকে আমরা ঠিকমতো বুঝে থাকি তা হলে তুমি সম্ভবত খানিকটা ক্ষুব্ধ। তিন শ নয় নম্বর ক্লোন মেয়েটি-যে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নায়ীরা বলে ঘোষণা করে আসছে, তাকে কেন আকাশের এত ওপরে রক্তক্ষরণে নিঃশেষিত করা হল, তুমি নিশ্চয়ই সেটি বোঝার চেষ্টা করছ। ক্লোন তিন শ নয় নিজেকে একটি নাম দিয়ে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার কোনো নাম পাওয়ার অধিকার নেই। সে একটি ক্লোন এবং যেখান থেকে আমরা তাকে এনেছি সেখানে হুবহু তার মতো আরো দশটি ক্লোন রয়েছে। প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রয়োজনে এই ক্লোনদের প্রস্তুত করা হয় এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রয়োজনে তাদের খরচ করা হয়।