নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষ আর মানুষ যদি যুদ্ধ না করত তা হলে পৃথিবীটা কী সুন্দর হত, তাই না রিশি।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ।
রিশি, তোমার কি মনে হয় যে, একদিন মানুষ এত উন্নত হবে যে তারা বুঝতে পারবে যুদ্ধবিগ্রহ করার কোনো অর্থ নেই। তারা একজনের সঙ্গে আরেকজন যুদ্ধ করবে না?
আমার মনে হয় হবে। নিশ্চয়ই হবে।
.
দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এল। আকাশে আধখানা চাঁদ এবং অসংখ্য নক্ষত্র। নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে নক্ষত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবী থেকে কত লক্ষ কোটি মাইল দূরে ওই নক্ষত্রগুলো, সেখানে কি পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহ আছে? সেই গ্রহে কি মানুষের মতো কোনো প্রাণী আছে? সেই প্রাণী কি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে একই কথা ভাবছে? নায়ীরা অকারণে নিজের ভেতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করে।
গ্লাইডারটি হঠাৎ মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপতে শুরু করে। নায়ীরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হল?
কিছু না। আমি গতিপথটা একটু পরিবর্তন করছি।
রিশি।
বলো।
গ্লাইডার চালানো কি খুব কঠিন?
একেবারেই কঠিন না। এটা নিজে ভেসে থাকে। পাখাগুলো নাড়াচাড়া করে গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
বিজ্ঞান কেন্দ্রের একজন বলেছিল, তুমি নাকি পৃথিবীর সেরা গ্লাইডার পাইলট!
রিশি শব্দ করে হেসে বলল, ঠাট্টা করে বলেছে। কারণ কাজটা এত সোজা যে, এর মধ্যে সেরা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রিশি হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি গ্লাইডার চালানো শিখতে চাও?
নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কে? আমি?
হ্যাঁ।
আমি কেমন করে শিখব?
তুমি যদি সাহস করে ফিউজলেজের ওপর দিয়ে আমার ককপিটে চলে আস আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।
আমি ফিউজলেজের ওপর দিয়ে চলে আসব?
হ্যাঁ। ককপিটে যথেষ্ট জায়গা আছে। একটু চাপাচাপি হবে কিন্তু দুজন বসতে পারব।
নায়ীরা উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি সত্যি বলছ?
হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। তবে খুব সাবধান, পড়ে যেও না যেন। তা হলে বিজ্ঞান কেন্দ্রের লোকজন আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
নায়ীরা সিটবেল্ট খুলে নিজেকে মুক্ত করতে করতে বলল, আমি পড়ব না।
ককপিট থেকে শরীরটা বের করে ফিউজলেজটা আঁকড়ে ধরে নায়ীরা সাবধানে সামনে অগ্রসর হতে থাকে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, ভয়ে সে নিচে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। মনে হতে থাকে একটু অসাবধান হলেই বুঝি বাতাস তাকে উড়িয়ে নেবে।
কিন্তু সেরকম কিছু হল না, রিশির কাছাকাছি আসতেই সে হাত বাড়িয়ে খপ করে নায়ীরাকে ধরে ফেলে তারপর শক্ত হাতে তাকে টেনে ককপিটে ঢুকিয়ে নেয়। নায়ীরা ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, কী মজা হল, তাই না?
পড়ে গেলে মজাটা বের হত! অবমানবেরা যখন দেখত আকাশ থেকে পরী নেমে আসছে, কী অবাক হত বলো দেখি?
কিন্তু সেই পরী তো উড়তে উড়তে নামত না, ঢেলার মতো পড়েই থেঁতলে যেত!
এগুলো হচ্ছে ছোটখাটো ঘুঁটিনাটি। উড়ে উড়ে নামলেও পরী, ঢেলার মতো নামলেও পরী। আকাশ থেকে ফুটফুটে একটা মেয়ে নামছে, সেটাই হচ্ছে বড় কথা।
নায়ীরা কৌতূহল নিয়ে ককপিটের দিকে তাকাল। ভেতরে অনেকগুলো মিটার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। রিশি তার একটা দেখিয়ে বলল, এই যে এটা দেখাচ্ছে আমরা কত উঁচুতে আছি, আর এটা দেখাচ্ছে আমাদের গতিবেগ। এই এটা দেখাচ্ছে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। আমরা কোনদিকে যেতে চাই সেটা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছি। যখন সেটা থেকে একটু সরে যায় আমাকে আবার নিজের হাতে আবার ঠিক করে নিতে হয়।
রিশি একটা একটা করে নায়ীরাকে দেখিয়ে দেয়। নারীরা কৌতূহল নিয়ে দেখে, রিশির অনুমতি নিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্লাইডারটা উড়িয়ে নেওয়ার ছোটখাটো বিষয়গুলো সে শিখে যায়। রিশি তাকে উড়িয়ে নিতে দেয় এবং নায়ীরা ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে গ্লাইডারটি উড়িয়ে নিয়ে যায়।
ছোট ককপিটে দুজন পাশাপাশি বসেছে। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। রিশি তাই ককপিটের ঢাকনাটা টেনে দেয়। কিছুক্ষণের ভেতরই ভেতরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। রিশি সামনের ড্রয়ার খুলে তাদের শুকনো খাবারের প্যাকেট বের করে, দুজনে খেতে খেতে হালকা গলায় গল্প করে।
নায়ীরা তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে ডান দিকের একটা স্ক্রিন দেখিয়ে বলল, এটা কী?
একটা ভিডিওস্ক্রিন। কেন রেখেছে বুঝতে পারছি না। চালু করার চেষ্টা করেছি, কোনো লাভ হয় নি।
নায়ীরা উচ্চতার মিটারটির দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ধীরে ধীরে আমাদের উচ্চতা কমে আসছে রিশি।
তুমি ঠিক করে নাও।
নায়ীরা উচ্চতা বাড়ানোর জন্য গ্লাইডারের পাখাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করে বলল, এখন আগের উচ্চতায় ফিরে এসেছি, কিন্তু আমাদের গতিবেগ কমে এসেছে।
যেটুকু কমেছে সেটা এমন কিছু নয়।
কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে?
রিশি একটু হেসে বলল, এটা অসম্ভব হালকা গ্লাইডার। এর কোথায় কতটুকু ওজন হবে সেটা একেবারে গ্রাম পর্যন্ত হিসাব করা আছে। তোমাকে সামনে নিয়ে আসায় ককপিটটায় ওজন বেশি হয়ে গেছে। তাই গ্লাইডারের ওজনের ব্যালেন্স ঠিক নেই, আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে।
নায়ীরা চিন্তিত মুখে বলল, তা হলে আমি পেছনে আমার ককপিটে চলে যাই।
কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ধীরেসুস্থে যেও। রিশি হঠাৎ কী মনে করে বলল, তার চেয়ে আরেকটা কাজ করা যাক।