চমৎকার। আরেকটু ওপরে উঠে নিই, তখন ছেড়ে দেব।
গ্লাইডারটি শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে। রিশি আস্তে আস্তে দড়িটি ছাড়ছে আর গ্লাইডারটি ওপরে উঠছে, অনেকটা ঘুড়ি ওড়ানোর মতো। যখন অনেক ওপরে যাবে তখন দড়ির বাধন খুলে গ্লাইডারটি মুক্ত হয়ে উড়ে যেতে শুরু করবে।
নায়ীরা তার ককপিট থেকে মাথা বের করে সাবধানে নিচে তাকাল। তারা পাহাড়ের চূড়া থেকে অনেক ওপরে উঠে গেছে। এখান থেকে ঝরনাধারাটিকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, মনে হচ্ছে সরু সাদা একটি সুতো ঝুলছে। নিচের বনাঞ্চল সবুজ গাছে ঢাকা। সামনে বহুদূরে সবুজ প্রান্তর, যেখানে অবমানবেরা তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা বুকের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। তারা কি এই ভয়াল উপত্যকা পার হয়ে সত্যিই টেহলিস শহরে যেতে পারবে?
রিশি তার কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রেখে খুব সাবধানে ওপরে উঠে যাচ্ছে। দুই পাশে গ্লাইডারের ডানা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, বাতাসে মাঝে মাঝে থরথর করে কাঁপছে। আকাশে সাদা মেঘ, একটু পরেই গ্লাইডারটা ওই সাদা মেঘের ওপর দিয়ে ভেসে যাবে। নারীরা নিচে তাকাল। তারা এত ওপরে উঠে এসেছে যে পাহাড়ের চূড়াটুকুও আর আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরো এলাকাটাই বুঝি একই সমতলের অংশ।
ককপিট থেকে রিশির গলা শোনা গেল, নায়ীরা, যেটুকু ওঠার কথা উঠে গেছি।
এখন তা হলে আমরা রওনা দেব?
হ্যাঁ। দড়িটুকু কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাইডারটা কিন্তু খানিকটা নিচে নেমে আসবে। ভরশূন্য মনে হবে নিজেকে, ভয় পেও না।
নায়ীরা হাসার চেষ্টা করল। বলল, পেলেও তোমাকে বুঝতে দেব না!
তোমার যেরকম ইচ্ছে। দেখতে দেখতে গ্লাইডারের বেগ বেড়ে যাবে, ইচ্ছে করলে ককপিটের ঢাকনাটা টেনে দিতে পার।
এমনিতেই ভালো লাগছে।
বেশ। তুমি কি প্রস্তুত?
হ্যাঁ রিশি। আমি প্রস্তুত।
ককপিটটা শক্ত করে ধরে রাখ, আমরা যাচ্ছি।
পরমুহূর্তে নায়ীরা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। তারপর হঠাৎ করে তার মনে হতে থাকে সে নিচে পড়ে যেতে শুরু করেছে। নিজেকে তার রশূন্য মনে হতে থাকে, মনে হয় সে বুঝি খোলা ককপিট থেকে উড়ে বের হয়ে যাবে। গ্লাইডারটি গতি সঞ্চয় করছে। তার মুখের ওপর সে বাতাসের তীব্র বেগ অনুভব করতে থাকে।
রিশি চিৎকার করে বলল, তুমি ঠিক আছ নায়ীরা?
আছি।
চমৎকার।
গ্লাইডারটি মাথা নিচু করে খানিকটা নিচে নেমে গতি সঞ্চয় করেছে। রিশি এখন এটাকে সোজা করে নেয়। মেঘের ওপর দিয়ে তখন এটা ভেসে যেতে শুরু করে। একটু আগের সেই ভরশূন্য হয়ে উড়ে যাওয়ার অনুভূতিটা নেই। নায়ীরা মুখের ওপর প্রবল বাতাসের ঝাঁপটা অনুভব করে। সে সামনের ড্রয়ার খুলে এক জোড়া গগলস বের করে চোখে পরে নেয়।
বিকেলের পড়ন্ত আলোতে চারপাশে এক ধরনের মায়াময় পরিবেশ, তার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে তারা গ্লাইডারে করে আকাশের মেঘের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা অনুভূতি। নায়ীরা ককপিট থেকে মাথা বের করে সাবধানে নিচে তাকাল। অনেক নিচে গাছপালা, বনবাদাড়, সরু সুতার মতো নদী। নায়ীরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রিশি ককপিটে তার রেডিওটি চালু করে কিছু একটা শুনছে। একটু পর রেডিও বন্ধু করে দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, উষ্ণ প্রবাহটি চলে এসেছে। চোখ বন্ধ করে আট শ কিলোমিটার চলে যাব।
কতক্ষণ লাগবে?
ধরে নাও, সারা রাত।
সারা রাত চুপচাপ করে বসে থাকব?
বসে থাকতে হবে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকবে, নাকি কথা বলতে থাকবে সেটা তোমার ইচ্ছে।
বাতাসের জন্য কথা বলা যায় না। চিৎকার করে আর কতক্ষণ কথা বলা যায়?
রিশি হাসল। বলল, ঠিকই বলেছ?
নায়ীরা তার জ্যাকেটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, তুমি উষ্ণ প্রবাহের কথা বলছ, কিন্তু এখানে তো দেখছি বেশ ঠাণ্ডা।
অন্ধকারটা নামুক তখন দেখবে ঠাণ্ডা কাকে বলে। ককপিটের ঢাকনা ফেলে তখন ভেতরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হবে।
নায়ীরা দুই হাত ঘষে একটু গরম হওয়ার চেষ্টা করতে করতে ককপিটে আরাম করে বসে থাকার চেষ্টা করল। মাত্র কয়েক দিন আগেই তার এক ধরনের নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে জীবন ছিল, এখন হঠাৎ করে পুরো জীবনটি পাল্টে গেছে। মাথায় করে সে একটা তথ্য নিয়ে যাচ্ছে টেহলিস শহরে, কথাটা যদিও সে বিশ্বাস করে না। তবে সে যে কিছু একটা নিয়ে যাচ্ছে, সে কথাটি সত্যি। কী নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে কে জানে! নায়ীরা দূরে। অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকাল। নিচে বিস্তীর্ণ বনভূমিতে এখন নিশ্চয়ই অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশের কাছাকাছি সূর্যটা যাই যাই করেও যেতে পারছে না। চারপাশে সাদা মেঘে সূর্যের রশ্মিটুকুকে কী অপূর্বই না দেখায়! সে কি কখনো ভেবেছিল, তার ধরাবাঁধা ক্লোন-জীবনে কখনো এরকম একটি দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে?
হঠাৎ বহুদূর থেকে গুম গুম শব্দ ভেসে আসে। নায়ীরা চমকে উঠে বলল, কিসের শব্দ?
রিশি দূরে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, জানি না, মনে হয় অবমানব গোলাগুলি শুরু করেছে।
আমাদের গুলি করেছে?
না। অনেক দূর থেকে শব্দ আসছে। আমাদের দিকে নয়।
আমাদের কি ওরা গুলি করতে পারে?
সম্ভাবনা খুব কম। অন্ধকার নেমে আসছে, আমাদের আর দেখা পাবে না। নিরাপত্তার। জন্য আমরা ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন পর্যন্ত ব্যবহার করছি না।