না, না-, নায়ীরা কাতর গলায় বলল, আমাকে একা ফেলে রেখে যেও না।
রিশি নায়ীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি যাব না। যদি দেখি তোমার খুব বেশি জ্বর উঠে গেছে তা হলে তোমাকে পাঁজাকোলা করে ওপরে নিয়ে যাব।
নায়ীরা রিশির কথা ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হল না। সে শূন্যদৃষ্টিতে রিশির দিকে। তাকিয়ে রইল। তার চোখ ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে উঠছে, ঠোঁটগুলো শুকনো এবং কেমন যেন নীল হয়ে আসছে। নায়ীরা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। রিশি নিজের জ্যাকেটটা খুলে নায়ীরার শরীরকে ঢেকে দিয়ে তাকে শক্ত করে ধরে রাখে। নায়ীরা চাপা গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলল, রিশি ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কী বলছ নায়ীরা?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে।
কে তোমাকে মেরে ফেলবে?
সবাই মিলে। নায়ীরা শূন্যদৃষ্টিতে রিশির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার শরীরে ওরা বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
নায়ীরা জ্বরের ঘোরে কথা বলছে, তবুও রিশি কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল। বলল, কেমন করে বিষ ঢুকিয়েছে?
আমাকে অচেতন করে আমার বাম হাতের শিরার ভেতরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি জানি।
তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো না নায়ীরা। আমি তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করব।
নায়ীরা বিড়বিড় করে বলল, গত পনের বছরে আমার কখনো অসুখ করে নি। আমার কেন এখন অসুখ হল? কেন?
রিশি নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, এটা হয় নায়ীরা। সব মানুষের ছোট বড় অসুখ হয়। হতে হয়।
নায়ীরা বিড়বিড় করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তারপর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে রিশির ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।
রিশি সাবধানে নায়ীরাকে পাথরের ওপর শুইয়ে দিয়ে ঝরনা থেকে আঁজলা করে পানি নিয়ে এসে ভেজা কাপড় দিয়ে তার মুখ, হাত-পা মুছে দেয়। তার নাড়ি, নিশ্বাস স্বাভাবিক। জ্বরটুকু কমিয়ে দিতে পারলেই কোনো বিপদের ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু রিশি কিছুই করতে পারছে না। সে নায়ীরার হাত ধরে বসে রইল।
ধীরে ধীরে নায়ীরার জ্বর আরো বাড়তে থাকে। ছটফট করতে করতে কাতর গলায় তার বোনদের ডাকতে থাকে সে। আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। একসময় শরীরে অপ্রতিরোধ্য এক ধনের খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। রিশি নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে রেখে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, নায়ীরা একটু সহ্য কর। একটু সহ্য কর, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখো, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে-সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সমস্ত শরীরে খিচুনি দিতে দিতে একসময় হঠাৎ নায়ীরার শরীর অবশ হয়ে এলিয়ে পড়ে। রিশি তার হৃৎস্পন্দন, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরীক্ষা করে দেখে, তার সারা শরীর ঘামতে শুরু করেছে। নায়ীরার ওপর থেকে রিশি নিজের জ্যাকেটটি সরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্বর নামতে শুরু করে। রিশি নায়ীরার মাথার কাছে বসে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে।
ঘণ্টাখানেক পর নায়ীরা চোখ মেলে তাকাল। রিশি তার ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন লাগছে নায়ীরা?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, ভালো।
চমৎকার। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। রিশি জিজ্ঞেস করল, তোমার কি আগে কখনো এরকম জ্বর উঠেছিল?
না।
জ্বরের ঘোরে তুমি তোমার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার কথা বলছিলে। কথাটা কি তোমার মনে আছে?
নায়ীরা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, মনে আছে।
কেন বলছিলে সেটা?
নায়ীরা তার বাম হাত বের করে একটা লাল বিল্টুকে দেখিয়ে বলল, এই যে এখানে দেখ। এখান দিয়ে তারা আমার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
রিশি বিন্দুটা ভালো করে পরীক্ষা করল। সেখানে একটা সুচ ঢুকানো হয়েছিল, এত দিন পরেও সেটা বোঝা যাচ্ছে।
রিশি বলল, তোমার শরীরে কেন বিষ ঢোকাবে?
আমি জানি না।
রিশি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি অসুস্থ। তুমি কি টেহলিস শহরের যাত্রা শুরু করতে চাও? নাকি আমরা ফিরে যাব?
না। নায়ীরা মাথা নাড়ল, আমি ফিরে যেতে চাই না। তা ছাড়া-
তা ছাড়া কী?
আমার এখন নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছে না।
নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। ঝরনার জলধারার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ইস! কী। সুন্দর।
রিশি বলল, আমাদের এখন যেতে হবে নায়ীরা।
চল যাই।
দুজন পাথরে পা রেখে হাঁটতে হাঁটতে ওপরে উঠতে থাকে। রিশি পকেট থেকে তার ঘোট ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা বের করল। তাকে কখন কী করতে হবে সেখানে লেখা আছে। বিকেল পঁচটা তিরিশ মিনিট : গ্লাইডারে উড্ডয়ন। তার নিচে ছোট ছোট করে লেখা : গোপনীয়; অপরায়ু বা বিকেলে নায়ীরার সমস্ত শরীরে খিচুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর উঠতে পারে। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কোনোভাবেই টেহলিস শহরের অভিযান বন্ধ করা যাবে না।
রিশি নিঃশব্দে তার ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা বন্ধ করে পকেটে রেখে দেয়। নায়ীরার সন্দেহটি তা হলে আসলেই সত্যি?
৫. পাহাড়ের চূড়ার দমকা বাতাসে
পাহাড়ের চূড়ার দমকা বাতাসে দেখতে দেখতে গ্লাইডারটি ওপরে উঠে গেল। নায়ীরা তার ককপিটে বসে আছে, বেল্ট দিয়ে সিটের সঙ্গে বাঁধা, তারপরেও সে শক্ত করে ককপিটের দেয়াল ধরে রেখেছে। সামনের ককপিটে বসে থাকা রিশি গলা উঁচিয়ে বলল, ভয় পেও না। নায়ীরা, রুটাই একটু ঝামেলার। একবার ভেসে গেলে আর কোনো সমস্যা নেই।
নায়ীরার বুক ধুকধুক করছিল, কিন্তু সে বলল, আমি ভয় পাচ্ছি না রিশি।