কী?
আমরা যেটাকে সভ্যতা বলছি, সেটা ঠিকভাবে অগ্রসর হয় নি।
কেন? রিশি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, এরকম একটা কথা মনে হওয়ার কী কারণ?
মানুষ নিশ্চয়ই একসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকত। এখন প্রকৃতিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘোট ঘোট ঘুপচির ভেতরে থাকে। চার দেয়ালের ভেতরে থাকে। সূর্যের আলো বন্ধ করে নিজেরা আলো তৈরি করে। যখন অন্ধকার থাকার কথা, তখনো আলো জ্বেলে রাখে।
রিশি হেসে ফেলল, বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কী মনে হয় জান?
কী?
মানুষ নিশ্চয়ই আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাবে।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি একটা জিনিস কখনো বুঝতে পারি নি।
সেটা কী?
মানুষে মানুষে যুদ্ধ করে কেন?
সেটা শুধু তুমি নও, কেউ বুঝতে পারে না।
নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আগে পৃথিবীতে ছিল শুধু মানুষ। এখন নিজেরা নিজেরা দুই ভাগ হয়ে গেছে, মানব আর অবমানব! একজন আরেকজনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ভবিষ্যতে কি আরো ভাগ হবে, আরো বেশি যুদ্ধ করবে?
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না নায়ীরা। আমার ধারণা, কেউই জানে না।
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে কফির মগে চুমুক দেয়। পাথরে হেলান দিয়ে দূরে তাকায়। ঘন সবুজ বনে দূর প্রান্তর ঢেকে আছে। সেখানে ভয়ংকর অবমানবরা ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
রিশি কফির মগটি নিচে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, এস নায়ীরা, আমরা গ্লাইডারটা প্রস্তুত করি।
নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। গ্লাইডারটা বিশাল একটা সাদা পাখির মতো দুটো পাখা ছড়িয়ে রেখেছে। হালকা ফাইবার গ্লাসের কাঠামোর ওপর পাতলা পলিমারের আবরণ। পাহাড়ের চূড়ার দমকা হাওয়ায় যেন উঠে চলে না যায় সেজন্য পাথরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। রিশি পুরো গ্লাইডারটা ভালো করে পরীক্ষা করে সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে বলল, চমৎকার জিনিস। এর মধ্যে কোনো ফঁকিঝুঁকি নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর একেবারে সেরা ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করেছে।
নায়ীরা গ্লাইডারটার ওপরে হাত বুলিয়ে বলল, এত হালকা একটা জিনিস আমাদের দুজনকে নিতে পারবে?
শুধু আমাদের দুজনকে নয়, আমাদের জিনিসপত্র, খাবারদাবার সবকিছু নিতে পারবে। রিশি গ্লাইডারের সামনে ছোট ককপিটটা দেখিয়ে বলল, এখানে বসব আমি, আমার সামনে কন্ট্রোল প্যানেল। আর তুমি বসবে পেছনে।
নায়ীরা পেছনের ছোট ককপিটটা ভালো করে দেখল। ছোট হলেও সে বেশ আরাম করেই বসতে পারবে। দুজনের মাঝখানের অংশটুকু তাদের খাবারদাবার, জিনিসপত্র রাখার জন্য।
রিশি তার ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র বের করে গ্লাইডারে তুলতে থাকে। নায়ীরাও তার ব্যাগ খুলে নেয়। শুকনো খাবার, পানি, কিছু জ্বালানি, গরম কাপড়, স্লিপিং ব্যাগ বের করে সাজিয়ে রাখতে থাকে। সবকিছু রাখার পর রিশি ঢাকনাটা বন্ধ করে আবার সন্তুষ্টির মতো শব্দ করল। বলল, আমাদের কাজ শেষ। এখন শুধু অন্ধকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা। অন্ধকার হলেই রওনা দিতে পারব।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, আমাকে বলেছিলে একটা উষ্ণ বাতাসের প্রবাহ শুরু হবে, সেটা কি শুরু হয়েছে?
গোপনীয়তার জন্য আমাদের কাছে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। শর্টওয়েভ রেডিওতে আবহাওয়ার খবর শুনে অনুমান করতে হবে।
সেটা শুনবে না?
শুনব। গ্লাইডার ভাসিয়ে দেওয়ার পর শুনব। রেডিওটা আছে ককপিটে। রিশি দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের এখন আর কিছু করার নেই। চল জায়গাটা একটু ঘুরে দেখি।
চল। নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। বলল, এরকম একটা সুযোগ পাব, আমি কখনো ভাবি নি।
একটা ঝরনাধারার মতো শব্দ শুনছি। চল দেখি, জায়গাটা খুঁজে পাই কি না।
আবার হারিয়ে যাব না তো?
না। হারাব না। জি.পি.এস. আবিষ্কারের পর পৃথিবী থেকে কেউ কখনো হারিয়ে যায় নি।
ঝরনাটি খুঁজে বের করতে তাদের ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। পাহাড়ের ওপর থেকে বিশাল একটি জলধারা নিচে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। চারপাশে ভেজা কুয়াশার মতো পানির কণা, নিচে ঘন বৃক্ষরাজি। বড় একটা গ্রানাইট পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দুজন ঝরনাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশি বলল, কী সুন্দর!
একটি সুন্দর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে নায়ীরা প্রতিবারই উচ্ছাস প্রকাশ করেছে। এবারে এত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখেও রিশির কথার প্রতিধ্বনি তুলে নায়ীরা কিছু বলল না দেখে রিশি একটু অবাক হয়ে ঘুরে নায়ীরার দিকে তাকাল। নায়ীরা এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখ লালচে এবং মনে হল সে অল্প অল্প কাঁপছে। রিশি অবাক হয়ে বলল, নায়ীরা, তোমার কী হয়েছে?
নায়ীরা বলল, বুঝতে পারছি না। কেমন যেন শীত করছে। রিশি নায়ীরাকে স্পর্শ করে চমকে উঠল, শরীর উত্তপ্ত, যেন পুড়ে যাচ্ছে। বলল, সে কী? তোমার তো দেখি অনেক জ্বর। কখন জ্বর উঠেছে?
আমি জানি না। এই একটু আগে থেকে শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
রিশি নায়ীরাকে একটা পাথরের ওপর হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। বলল, তুমি এখানে বস। দেখি, কী করা যায়।
ছোটখাটো অসুখের জন্য তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র আছে, কিন্তু সঙ্গে করে কিছু নিয়ে আসে নি। রিশি নায়ীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখা যাক, জ্বরটা কতটুকু ওঠে। যদি বেশি ওঠে আমি তোমার জন্য ওপর থেকে ওষুধ নিয়ে আসব।