দূরত্বের হিসাবে খুব বেশি নয়, কিন্তু পাহাড়ি এলাকা। কখনো উপরে উঠতে হবে আবার কখনো নিচে নামতে হবে। রাস্তা নেই-ঝোঁপঝাড়, বনজঙ্গল ভেঙে হাঁটতে হবে, তাই সারা রাত লেগে যেতে পারে।
সারা রাত?
হ্যাঁ। রাতের মধ্যেই পৌঁছে যেতে চাই। পারবে না?
পারব।
চমৎকার।
দুজনই চোখে নাইটভিশন গগলস লাগিয়ে নিয়েছে। সেই গগলসে পুরো এলাকাটাকে অলৌকিক একটা জগতের মতো মনে হয়। চারপাশে ঝোপঝাড়, বড় বড় গাছ। দূরে হঠাৎ হঠাৎ কোনো রাতজাগা প্রাণী দেখা যায়। মানুষের পায়ের শব্দ শুনে ছুটে পালিয়ে গিয়ে দূর থেকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, এখানে কি বড় কোনো বন্য প্রাণী আছে?
আছে। পাহাড়ি চিতা আর ভালুক।
তারা আমাদের আক্রমণ করবে না তো?
করার কথা নয়। বনের প্রাণী মানুষকে ভয় পায়। আর যদি কাছাকাছি আসে তুমি অনেক আগেই দেখতে পাবে।
তা ঠিক।
দুজনে আবার নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। রিশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, নায়ীরা, তোমার সমস্যা হচ্ছে না তো?
না। হচ্ছে না।
হলে বলো।
বলব।
মানুষের শরীর খুব বিচিত্র জিনিস, তাকে দিয়ে যে কত পরিশ্রম করানো যায়, সেটি অবিশ্বাস্য।
ঠিকই বলেছ।
রিশি হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, নায়ীরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
তোমাকে মাঝে মাঝেই খুব আনমনা দেখি। কী ভাব তখন?
আমার ভাবার খুব বেশি কিছু নেই। আমার সঙ্গে যাদের ক্লোন করা হয়েছিল তারা ছাড়া আমার আপনজন কেউ নেই। আমি তাদের কথা ভুলতে পারি না। ঘুরেফিরে আমার শুধু তাদের কথা মনে হয়।
রিশি নরম গলায় বলল, খুবই স্বাভাবিক। আমি তোমার বুকের ভেতরকার যন্ত্রণাটা বুঝতেই পারছি।
পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে নায়ীরা বলল, না, রিশি। তোমরা সেই যন্ত্রণাটুকু বুঝতে পারবে না। প্রথমে আমরা ছিলাম উনিশ জন। একজন একজন করে সরিয়ে নেয়ার পর হয়েছি এগার জন। শেষ কত দিন এই এগার জন মিলে ছিলাম একটা পরিপূর্ণ অস্তিত্ব। তার মধ্যে থেকে একজনকে সরিয়ে নেওয়া হলে তার পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন।
আমি দুঃখিত, নায়ীরা।
নায়ীরা বলল, আমি প্রতি মুহূর্তে অন্যদের কথা ভাবতে থাকি। আমার মনে হয় তাদের সবাইকে একটিবার স্পর্শ করার জন্য আমি আমার পুরো জীবনটুকু দিয়ে দিতে পারব।
রিশি দ্বিতীয়বার বলল, আমি সত্যিই দুঃখিত, নায়ীরা।
.
রিশি এবং নায়ীরা যখন তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় তখন পুব আকাশ আলো হতে শুরু করেছে। পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল পাখির মতো ডানা মেলে একটা গ্লাইডার শুয়ে আছে। তার পাশে বসে দুজন তাদের পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে নেয়। দুজনে ক্লান্ত দেহে বড় পাথরে হেলান দিয়ে বসে লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিতে থাকে। রিশি নায়ীরার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগছে তোমার?
ভালো। চারদিকে তাকাতে তাকাতে নায়ীরা বলল, আমি প্রকৃতির এত সুন্দর রূপ আগে কখনো দেখি নি। শুধু মনে হচ্ছে
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে আমার অন্য বোনগুলোকেও যদি কোনোভাবে এখানে আনতে পারতাম তা হলে কী মজাটাই না হত।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। নায়ীরা তার ব্যাকপ্যাকে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে বলল, আমরা কখন রওনা দেব রিশি?
রিশি পাহাড়ের পাদদেশে ঘন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা অবমানবদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। দিনের আলোয় বের হতে চাইছি না। অন্ধকার হওয়ার পর গ্লাইডারটি ভাসিয়ে দেব।
তা হলে আমি এখন একটু বিশ্রাম নিতে পারি?
হ্যাঁ নায়ীরা, পার।
ঠিক আছে, আমি তা হলে একটু ঘুমিয়ে নিই।
ঘুমাও। আমি পাহারায় থাকব।
নায়ীরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। এই দীর্ঘ পথ বিশাল বোঝ টেনে এনে মেয়েটি সত্যি সত্যি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রিশি একটা পাথরে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকে। খুব ধীরে ধীরে চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছে। ভোরের প্রথম আলোতে একটা পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল একটা গ্লাইডারের পাখার নিচে গুটিসুটি মেরে একটি কিশোরী ঘুমিয়ে আছে। দৃশ্যটি অন্যরকম। রিশি তাকিয়ে থাকে, তার মনে হতে থাকে এটি আসলে ঘটছে না, এটি কল্পনার একটি দৃশ্য। ভালো করে তাকালেই দেখবে আসলে এটি এখানে নেই।
.
নায়ীরা যখন ঘুম থেকে উঠেছে তখন সূর্য অনেক ওপরে উঠে গেছে। পাহাড়ের চূড়ায় এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা।
কাছাকাছি রিশি যেখানে বসেছিল সেখানেই চুপচাপ বসে আছে। নায়ীরাকে জেগে উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ঘুম হল?
হ্যাঁ, এভাবে আগে কখনো ঘুমাই নি।
এভাবে নিশ্চয়ই আগে কখনো ক্লান্তও হও নি।
তুমি একটু বিশ্রাম নেবে না?
নিয়েছি। নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কখন নিয়েছ? তুমি তো এখানেই সারাক্ষণ বসে আছ।
রিশি হেসে বলল, এটাই আমার বিশ্রাম। আমার অভ্যাস আছে। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস, কিছু একটা খাই।
হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে।
পাহাড়ের বাতাস খুব সতেজ। এই বাতাসে নিশ্বাস নিলে এমনিতেই খিদে পায়। যাও, দেরি করো না।
খাবারের আয়োজনটুকু ছিল সহজ। এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো যবের রুটি, কিছু প্রোটিন আর গরম কফি। খাওয়া শেষ করে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে রিশি বলল, জীবনটা যদি এখানে থেমে যেত, মন্দ হত না। কী বলো?
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল হ্যাঁ। চারপাশে এত সুন্দর যে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমার কী মনে হচ্ছে জান?