আমুদে পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, পৃথিবীতে কি আমরা এই নাচ নাচতে পারব? কখনো পারব না।
না পারলে নাই। কিন্তু তোমরা যা শুরু করেছ আরেকটু হলে মহাকাশ স্টেশনের দেয়াল ভেঙে বের হয়ে যাবে।
জীববিজ্ঞানী কিরি বলল, আর একটু থুল।
উঁহু। আর না। তোমরা যেভাবে বেআইনি উত্তেজক পানীয় খাচ্ছ যদি পৃথিবীতে সেই খবর পৌঁছায় তা হলে নির্ঘাত আমাকে জেলে পুরে রাখবে।
নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। কথা দিচ্ছি আমরা প্রতি সপ্তাহে জেলে তোমার সাথে খাবারের প্যাকেট নিয়ে দেখা করতে আসব।
থুল জোর করে মুখ শক্ত করে বলল, তুমি আমাকে দেখতে আসবে না আমি তোমাকে দেখতে আসব সে ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত হলে কেমন করে?
রিশি ঠাট্টা করে কী একটা বলতে যাচ্ছিল সিকিউরিটি অফিসার থুল তার সুযোগ দিল। হাত নেড়ে বলল, আর ঠাট্টা-তামাশা নয়। পার্টি শেষ। এখন যে যার কাজে যাও।
কাজেই কিছুক্ষণের ভেতরে যে যার কাজে চলে গেল। নীরা ত্রাতিনার এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই, ভেসে ভেসে নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে তার রিশানের সাথে দেখা হয়ে গেল, হালকা গলায় বলল, খুব মজা হল আজকে তাই না?
রিশান অন্যমনস্ক গলায় বলল, হুঁ।
নীরা ত্রাতিনা রিশানকে ভালো করে লক্ষ করল, মুখটায় এক ধরনের দুশ্চিন্তার ছাপ। সে দেয়ালে হাত দিয়ে নিজেকে থামিয়ে বলল, কী ব্যাপার রিশান, কিছু হয়েছে নাকি?
না। কিছু হয় নি।
তা হলে তোমাকে এত দুশ্চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
ঐ গ্রহাণুটা-
কী হয়েছে গ্রহাণুটার?
পাজি গ্রহাণুটা একেবারে পৃথিবীর কক্ষপথে।
কত দূরে আছে?
এখনো অনেক দূর, প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন কিলোমিটার।
তা হলে এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? এত দূরে থাকতে কখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
রিশান চিন্তিত মুখে বলল, না, দুশ্চিন্তা করছি না। তবে
তবে কী?
যদি এটা তার গতিপথ না বদলায় তা হলে আমাদের এটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে। তার মানে বুঝতে পেরেছ?
নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বুঝতে পারছি। সেটা করতে হবে আমাদের।
হ্যাঁ।
নীরা ত্রাতিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে আমাদের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া পিছিয়ে যাবে।
হ্যাঁ। রিশান জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, পার্টিটা মনে হয় আমরা একটু আগেই করে ফেলেছি!
নীরা ত্রাতিনা বলল, মোটও আগে করি নি। ঠিক সময়ে করেছি।
কীভাবে ঠিক সময়ে করা হল?
যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে না পারি তা হলে এই গ্রহাণুকে আমাদের চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে। তা হলে ধরে নাও পার্টিটা হয়েছে পাজি গ্রহাণুকে চূর্ণবিচূর্ণ করা উপলক্ষে।
রিশান শব্দ করে হেসে বলল, মহাকাশে ছুটে আসা গ্রহাণুকে ধ্বংস করা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক, সবচেয়ে ভয়ংকর কাজগুলোর একটি। সেটা উপলক্ষে পার্টি করতে হলে বেশ নার্ভের প্রয়োজন!
নীরা ত্রাতিনা বলল, আমার নার্ভ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
রিশান বলল, জানি।
যদি সত্যি সত্যি নিউক্লিয়ার মিসাইল নিয়ে যেতে হয় আমি কিন্তু যাব।
ঠিক আছে।
এখন কি তুমি টেলিস্কোপে আবার গ্রহাণুটাকে দেখতে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
আমি কি তোমার সাথে দেখতে পারি?
হ্যাঁ। অবশ্যই দেখতে পার।
নীরা ত্রাতিনা আর রিশান ভেসে ভেসে মহাকাশ স্টেশনের বড় টেলিস্কোপটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
.
এই মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবী থেকে দুই হাজার কিলোমিটার উপরে একটা কক্ষপথে বসানো রয়েছে। দুই ঘণ্টার কাছাকাছি সময়ে এটা পৃথিবীকে একবার করে প্রদক্ষিণ করে। এই মহাকাশ স্টেশনে সব সময় বিজ্ঞানীদের একটি দল থাকে, মহাকাশ নিয়ে নানা গবেষণা করার জন্য তাদের পাঠানো হয়। দৈনন্দিন কাজের বাইরেও তাদের আরো নানা ধরনের কাজ করতে হয়-কোনো একটি গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ছুটে এলে সেটাকে মাঝপথে থামিয়ে বিস্ফোরিত করে দেওয়া সেরকম একটা কাজ।
টেলিস্কোপের আইপিসে চোখ লাগিয়ে নীরা ত্রাতিনা বলল, কী বীভৎস দেখতে!
হ্যাঁ, এই গ্রহাণুটা দেখতে ভালো নয়।
কেমন লালচে রং দেখছ? পচা ঘায়ের মতন।
রিশান বলল, হ্যাঁ। এটা এস-টাইপ গ্রহাণু। লোহা আর ম্যাগনেসিয়ামে তৈরি। শতকরা পনের ভাগ গ্রহাণু এরকম।
নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, প্রহাণুটা তার কক্ষপথ ছেড়ে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে শুরু করল কেন?
ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত অন্য কোনো গ্রহাণুর সাথে ধাক্কা লেগে গতিপথ পাল্টে গেছে।
নীরা ত্রাতিনা খানিকক্ষণ গ্রহাণটা লক্ষ করে বলল, গ্রহাণ হিসেবে এটা বেশ বড়।
হ্যাঁ। প্রায় বারো কিলোমিটার। সত্যি সত্যি পৃথিবীতে আঘাত করলে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে।
নীরা ত্রাতিনা টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে বলল, শুধু শুধু দুশ্চিন্তা না করে চল এর গতিপথটা বের করে ফেলি।
হ্যাঁ। আমি সেজন্য এসেছি।
আমার এখন সেরকম কোনো কাজ নেই। তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
অবশ্যই। তুমি যদি শুধু পাশে বসে থাক তা হলেই আমার অনেক বড় সাহায্য হবে। একা একা এই বিদঘুটে গ্রহাণুটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না।
তোমার ভয় নেই রিশান, আমি তোমার সাথে আছি।
পরবর্তী ছয় ঘণ্টা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে গ্রহাণুর গতিপথটি ছকে ফেলে নীরা ত্রাতিনা আর রিশান আবিষ্কার করল টোরকা নামের বারো কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটা গ্রহাণু মূর্তিমান বিভীষিকার মতো পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। গ্রহাণুটি লালচে, আকৃতি একটু লম্বা এবং পৃষ্ঠদেশ অসমতল। গ্রহাণুটি ঘুরছে এবং সে কারণে গতিপথ অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে একচল্লিশ দিনের মাথায় এই গ্রহাণুটির বায়ুমণ্ডলে ঢোকার কথা।