কিন্তু কী?
আমি কেন জানি হিসাব মেলাতে পারছি না। তারা বলেছে, আমার মস্তিষ্কে করে একটি গোপন তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু সেটি তো সত্যি হতে পারে না। পারে?
রিশি বলল, আমি সেটা জানি না।
নায়ীরা বলল, আমি তাদের সেটা জিজ্ঞেস করেছি, তারা ঠিক উত্তর দিতে পারে নি।
রিশি বলল, হয়তো তারা এর উত্তর জানে না।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু তারা আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছে।
মিথ্যা কথা বলেছে?
হ্যাঁ, নায়ীরা বলল, কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি কেমন করে জানি টের পেয়ে যাই।
সেটি কেমন করে হতে পারে?
আমি জানি না। আমি আমাদের ক্লোন করা বোনদের সঙ্গে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কাটাতাম। তাদের কথা বলার একটা ধরন আছে, সেটা আমরা জানি। আমাদের কখনোই একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিথ্যা বলতে হত না। তাই সত্যি কথা বলার ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক। মিথ্যে বললেই অস্বাভাবিক মনে হয়।
রিশি ঘুরে ভালো করে নায়ীরার দিকে তাকাল। মনে হল তাকে ভালো করে একবার দেখল। তারপর বলল, আমি কি কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলেছি?
নায়ীরা হেসে ফেলল, বলল, না। সেজন্য তোমার ওপর আমি নির্ভর করি। তা ছাড়া-
তা ছাড়া কী?
তুমি মিথ্যা বলতে পার না। তাই তুমি যখন মিথ্যা বলার চেষ্টা কর, তখন সবাই সেটা বুঝে ফেলে।
রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি? আমি কি কখনো চেষ্টা করেছি?
হ্যাঁ। নায়ীরা মুখ টিপে হেসে বলল, কদিন আগে একবার চেষ্টা করেছিলে। টেবিল থেকে কী একটা জিনিস তুলে খুব যত্ন করে একটা কাগজে ভাঁজ করে রাখছিলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী তুলছ? তখন তুমি চমকে উঠে আমতা-আমতা করে বললে, না মানে ইয়ে একটা বিচিত্র পোকা। মনে আছে?
রিশির মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, হ্যাঁ, মনে আছে।
নায়ীরা বলল, সেটা পোকা ছিল না। সেটা অন্য কিছু ছিল। তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে! কিন্তু সেটা অন্যরকম মিথ্যা। তার মধ্যে কোনো অন্যায় ছিল না।
রিশি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ নায়ীরা। তুমি অসাধারণ একটি মেয়ে।
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি কিন্তু অসাধারণ মেয়ে হতে চাই নি। খুব সহজ সাধারণ একটি মেয়ে হতে চেয়েছিলাম।
যা-ই হোক, তুমি কি জানতে চাও, আমি সেদিন টেবিল থেকে কী তুলেছিলাম?
না। তুমি যেহেতু বলতে চাও নি, আমি সেটা জানতে চাই না।
ঠিক আছে।
তা ছাড়া আমি অনুমান করতে পারি তুমি কী তুলেছিলে এবং কেন তুলেছিলে, তাই জানার প্রয়োজনও নেই।
রিশি চোখ বড় বড় করে নায়ীরার দিকে তাকাল। নায়ীরা বলল, পুরো ব্যাপারটা করেছ আমার জন্য, আমার ভালোর জন্য। তাই আমি এখন না জানলেও কোনো ক্ষতি নেই। একসময় আমি জানব। কারণ তুমি আমাকে জানাবে।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, নায়ীরা, তুমি একটি অসাধারণ এবং এবটি বিচিত্র মেয়ে।
নায়ীরা বলল, আমি যদি অন্য দশজন মানুষের মতো বড় হতে পারতাম তা হলে হয়তো বিচিত্র হতাম না।
একটু আগে তুমি যে বিষয়টা বলেছ সেটা অন্য কেউ বললে আমি একেবারেই গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু যেহেতু তুমি বলছ, আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিত থাক নায়ীরা, আমরা রওনা দেওয়ার পর কীভাবে যাব তার পুরোটুকু আমি ঠিক করে নেব। তোমাকে আমি সুস্থ দেহে টেহলিস শহরে পৌঁছে দেব।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
বিজ্ঞান কেন্দ্র যদি সত্যি সত্যি তোমাকে আর আমাকে মাঝপথে মেরে ফেলার চেষ্টা করে, আমি সেটা হতে দেব না। আমি তোমাকে রক্ষা করব।
আমি জানি, তুমি আমাকে রক্ষা করবে।
সত্যি সত্যি কেউ যদি তোমাকে হত্যা করতে চায়, তুমি জেনে রাখ নায়ীরা, তোমাকে হত্যা করার আগে আমাকে হত্যা করতে হবে।
ঠিক কী কারণ জানা নেই নায়ীরা হঠাৎ মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বলল, কেউ যদি আমাকে এখন মেরেও ফেলে তবুও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
রিশি এগিয়ে এসে নায়ীরাকে শক্ত করে বলল, কেউ তোমাকে মেরে ফেলতে পারবে না, নায়ীরা। কেউ না।
.
ইঞ্জিনটা থামার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে রিশি নেমে আসে। বাইরে অন্ধকার, আকাশে বড় একটা চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোয় পুরো এলাকাটাকে একটা অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছে। পাহাড়ের শীতল ও সতেজ বাতাসে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে রিশি নায়ীরাকে ডাকল, নায়ীরা, নেমে এস।
নায়ীরা তার ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে নিচে নেমে এল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, কী সুন্দর।
হ্যাঁ। রিশি বলল, দিনের আলোতে জায়গাটা আরো সুন্দর দেখাবে।
গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে একজন বলল, আমি তা হলে যাই?
রিশি বলল, যাও।
মানুষটি বলল, তোমাদের জন্য শুভকামনা।
ধন্যবাদ।
গাড়িটি গর্জন করে উঠে ঘুরে পাহাড়ি পথ দিয়ে নেমে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বহুদূরে হেডলাইটের আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। রিশি আবছা অন্ধকারে নায়ীরার দিকে তাকাল। বলল, আমাদের দ্রুত এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।
কেন?
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনে যদি কোনো অবমানব এসে পড়ে!
নায়ীরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, এটি কি অবমানবের এলাকা?
না, কিন্তু এরা খুব দুধর্ষ। মাঝে মাঝেই পার্বত্য এলাকায় হানা দেয় বলে শুনেছি।
নায়ীরা বলল, চল, তা হলে সরে যাই।
হ্যাঁ, চল।
দুজন তাদের কাঁধে ব্যাকপ্যাক তুলে নেয়। রিশি একবার আকাশের দিকে তাকায়, তারপর পকেট থেকে জি.পি.এস. বের করে কোনদিকে যেতে হবে ঠিক করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। তার থেকে কয়েক পা পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নায়ীরা বলল, আমাদের কতদূর যেতে হবে?