নায়ীরা হেসে ফেলল, বলল, তুমি বারবার ভুলে যাচ্ছ যে আমি একজন ক্লোন। আমি আমার পছন্দের একটি গান শোনার চেষ্টাটুকুও করতে পারি না।
রিশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত।
নায়ীরা বলল, আমি মোটও দুঃখিত নই। তোমার সঙ্গে খুব বড় একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাব চিন্তা করেই আমার মনে হচ্ছে আমার ক্লোন হয়ে থাকার সব দুঃখ মুছে গেছে।
রিশি কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
রিশির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর হঠাৎ করে নায়ীরার জীবনটুকু অন্যরকম হয়ে গেল। এত দিন বিজ্ঞান কেন্দ্রে তাকে তুচ্ছ একজন ক্লোন হিসেবে দেখা হয়েছে। হঠাৎ করে রিশি তাকে পুরোপুরি একজন মানুষ হিসেবে দেখছে। রিশির তুলনায় সে একটি বাচ্চা শিশু ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু রিশি তাকে কখনোই ছোট শিশু হিসেবে দেখছে না। প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে, পরামর্শ করছে। নারীরা প্রথম প্রথম ভেবেছিল, রিশি বুঝি তাকে। একটু খুশি করানোর জন্য এগুলো করেছে, কিন্তু কয়েক দিনের ভেতরেই বুঝে গেল, সে সত্যি সত্যি তার সাহায্য চাইছে। টেহলিস শহরের ভ্রমণটুকু শুরু হবে একটা পার্বত্য অঞ্চল থেকে। সেই পার্বত্য অঞ্চলের একটা বড় অংশ তাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। উঁচু একটা পাহাড়ে একটা গ্লাইডার রাখা থাকবে। সেই গ্লাইডারে করে দুজন অবমানবের এলাকার ওপর দিয়ে ভেসে যাবে। সত্যিকারের একটা প্লেনে না গিয়ে গ্লাইডারে কেন যেতে হবে নায়ীরা সেটা বুঝতে পারছিল না। ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটরকে জিজ্ঞেস করার পর মানুষটি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্লেনে কেমন করে যাবে? নিচে পুরো এলাকাটাতে অবমানবরা থাকে। তারা যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। ভয়ংকর সব। অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্লেন রাডারে ধরা পড়া মাত্রই মিসাইল ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, গ্লাইডারকে ফেলবে না?
কীভাবে ফেলবে? গ্লাইডার যেসব হালকা জিনিস দিয়ে তৈরি হয় সেগুলো রাডারে ধরা পড়ে না।
দেখতেও পাবে না?
না। বছরের এই সময়ে এলাকায় মেঘ থাকে। মেঘের ওপর দিয়ে গ্লাইডার উড়ে যাবে, অবমানবরা টের পাবে না।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু গ্লাইডার তো আকাশে বেশি সময় ভেসে থাকতে পারবে না। কখনো না কখনো নিচে নেমে আসবে।
ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটর মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমরা একটু উষ্ণ বাতাসের প্রবাহের জন্য অপেক্ষা করছি। সেটা এলে বড় একটা এলাকায় বাতাস উপরে উঠে আসবে। তার উপর ভর করে অনেক দূর চলে যাওয়া যাবে।
সেটা কত দূর?
আমরা এখনো জানি না। রিশি একজন প্রথম শ্রেণীর গ্লাইডার পাইলট, আমাদের ধারণা সে অনায়াসে সাত-আট শ কিলোমিটার উড়িয়ে নিতে পারবে।
তারপর?
তারপরের অংশটুকু দুর্গম। দুর্গম বলে অবমানবের বসতিও কম। তোমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না, রিশি ব্যাপারটি দেখবে।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমিও একটু ধারণা করতে চাই।
হঠাৎ করে ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটরের মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় বলল, যেসব বিষয়ে তোমার ধারণা থাকার কথা শুধু সেসব বিষয়ে তোমাকে ধারণা দেওয়া হবে। অহেতুক কৌতূহল দেখিয়ে কোনো লাভ নেই মেয়ে।
নায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল।
রিশির কাছে এরকম কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো বিষয়ে নারীরা তাকে প্রশ্ন করতে পারে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রিশি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়। গ্লাইডারে করে তারা কত দূর যেতে। পারবে নায়ীরা একদিন রিশির কাছে জানতে চাইল। রিশি চিন্তিত মুখে বলল, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। আমাকে বাতাসের প্রবাহের যে ম্যাপ দিয়েছে তার থেকে অনুমান করতে পারি যে, ছয় থেকে সাত শ কিলোমিটার যেতে পারবে।
বাকিটুকু? বাকিটুকু কেমন করে যাব?
রিশি হেসে বলল, হেঁটে!
হেঁটে?
হ্যাঁ। গোপনে যেতে হলে হেঁটে না গিয়ে লাভ নেই।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু পুরোটুকু তো হেঁটে যেতে পারবে না। শেষ অংশটুকুতে জলাভূমি রয়েছে। সেখানে?
রিশি ঠাট্টা করে বলল, কেন, সাঁতরে যাবে? তুমি সাঁতার জান না? না
য়ীরা মাথা নেড়ে বলল, ঠাট্টা করো না। সত্যি করে বলো।
রিশি তখন গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা সেই অংশটুকু কীভাবে যাব সেটি নিয়ে এখন আলাপ করছি। ওপর থেকে নানারকম পরিকল্পনা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু পরিকল্পনাগুলো বেশিরভাগ সময়ে খুব দুর্বল।
দুর্বল?
হ্যাঁ।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, আচ্ছা রিশি, এমন কি হতে পারে যে শেষ অংশটুকুর আসলে কোনো পরিকল্পনা নেই?
রিশি অবাক হয়ে বলল, পরিকল্পনা নেই?
না।
কেন থাকবে না?
কারণ সেখানে পৌঁছানোর আগেই কিছু একটা হবে।
রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, কিছু একটা হবে? কী হবে?
আমরা মারা পড়ব। নিশ্চিতভাবে মারা পড়ব।
কেমন করে মারা পড়ব? কেন মারা পড়ব?
নায়ীরা বলল, সেটা আমি জানি না। কিন্তু যারা আমাদের পাঠাচ্ছে তারা সেটা জানে।
রিশি কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এরকম অদ্ভুত একটি বিষয় তোমার মাথায় কেমন করে এল?
নায়ীরা একটু লজ্জা পেয়ে যায়, মাথা নিচু করে বলল, আমি দুঃখিত রিশি যে বিজ্ঞান কেন্দ্রের এত বড় বড় মানুষকে নিয়ে আমি সন্দেহ করছি। কিন্তু