নায়ীরা আহত গলায় বলল, আমি দুঃখিত যে তোমাকে এটা আগে থেকে বলে দেয় নি। আমি সত্যিই দুঃখিত যে, টেহলিস শহরে সত্যিকার একজন মানুষ না নিয়ে তোমার একজন ক্লোনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
না-না-না, মানুষটি তীব্র গলায় বলল, আমি সে কথা বলছি না। পৃথিবীতে বহু আগে আইন করে ক্লোন তৈরি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তা হলে তোমাকে কেন তৈরি করা হল?
আসলে আইনের ভেতর ফাঁকফোকর থাকে। সাধারণত ক্লোন তৈরি করা নিষেধ, কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বিশেষ প্রয়োজনে বিজ্ঞান কেন্দ্রকে অনুমতি দেওয়া হয়।
যদি অনুমতি দেবে, তা হলে তাকে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে দেবে না কেন? তাকে চার দেয়ালের মধ্যে আটক রাখবে কেন? স্কুলে যেতে দেবে না কেন-
নায়ীরা আবার জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি নিশ্চিত, বাইরের মানুষ যদি আমাদের কথা জানে তা হলে তারা ঠিক তোমার মতো কথা বলত। কিন্তু বাইরের মানুষ আমাদের কথা কোনোদিন জানবে না আমরা হচ্ছি অত্যন্ত গোপনীয় একটা প্রজেক্ট! তুমিও নিশ্চয়ই কোনোদিন আমাদের কথা বাইরে জানাতে পারবে না
মানুষটি হতচকিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলছ। আমাকে অঙ্গীকার করতে হয়েছে এখানকার কোনো তথ্য কখনো বাইরে জানাতে পারব না। কখনোই না।
নায়ীরা বলল, কাজেই আমাদের কথা বাইরের পৃথিবীর কেউ কখনো জানবে না।
আমি খুব দুঃখিত।
আমার নাম নায়ীরা।
আমি খুব দুঃখিত, নায়ীরা।
নায়ীরা হাসিমুখে বলল, তুমি আমার অনেকখানি দুঃখ দূর করে দিয়েছ।
কীভাবে তোমার দুঃখ দূর করেছি?
আমি এখানে এসেছি প্রায় এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে আমি সবাইকে বলেছি আমার নাম নায়ীরা, কিন্তু কেউ একটিবারও আমাকে আমার নাম ধরে সম্বোধন করে নি।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন?
কারণ একজন ক্লোনের নাম থাকার কথা নয়। একটা ক্লোনের পরিচিতি হয় শুধু একটা সংখ্যা দিয়ে।
কী ভয়ংকর রকমের অমানবিক একটা নিয়ম।
বিচার-অবিচার বিষয়গুলো মানুষের জন্য। আমি মানুষ নই, আমি ক্লোন। একজন ক্লোন আর ল্যাবরেটরির গিনিপিগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
মানুষটি কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাছে এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, আমি খুব দুঃখিত, নায়ীরা। আমার নিজেকে মনে হচ্ছে একটা দানব-
তোমার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই- বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে নায়ীরা মানুষটির দিকে প্রশ্নভাবে তাকাল।
মানুষটি বলল, আমার নাম রিশি।
তোমার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই রিশি।
আছে। নিশ্চয়ই আছে।
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, না, নেই। তুমি পুরো বিষয়টুকু দেখছ তোমার মতো করে। একজন মানুষের পক্ষ থেকে একজন মানুষ তার জীবনে যা কিছু পায় আমরা তার। কিছু পাই না, তোমাকে সেটা ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, করবে না?
হয়তো করবে। কিন্তু পুরো বিষয়টা আমাদের পক্ষ থেকে দেখলে করবে না। জন্মের পরমুহূর্ত থেকে আমরা জানি, আমরা ক্লোন, আমাদের তৈরি করা হয়েছে ক্লোন গবেষণায় ব্যবহার করার জন্য। আমরা ধরেই নিয়েছি জন্ম হওয়ার পর একসময় আমাদের কেটেকুটে শেষ করে দেওয়া হবে। এর বাইরে আমরা যেটুকু পাই সেটাই আমাদের বাড়তি লাভ। সেটাই আমাদের জীবন।
রিশি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সেটা তো হতে পারে না।
কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে। আমরা এটা মেনে নিয়েছি। আমি মনে করি, আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান একজন-একজন- নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একজন মানুষ। হ্যাঁ, মানুষ। ক্লোন শব্দটা আমি ব্যবহার করছি না।
কেন তুমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মানুষ ভাবছ?
কারণ টেহলিস শহরের দুর্গম অভিযানের সময় তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার সঙ্গে আমি সময় কাটাতে পারব। মানুষ মানুষের সঙ্গে যেভাবে কথা বলে আমি তোমার সঙ্গে সেভাবে কথা বলতে পারব। তুমি জান আমার জন্য সেটা কত বড় ব্যাপার?
রিশি কোনো কথা না বলে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা বলল, আমরা সারা জীবন এরকম একটা কিছুর স্বপ্ন দেখে এসেছি। আমার আরো দশটি বোন আছে, তারা তাদের জীবনে কী পাবে আমি জানি না, কিন্তু আমি অন্তত একজন মানুষের কাছ থেকে। মানুষের সম্মান পেয়েছি।
রিশি নিচু গলায় বলল, তোমাকে প্রথম যখন দেখেছি তখন ভেবেছি তুমি নিশ্চয়ই বাচ্চা একটি মেয়ে। বয়সে তুমি আসলেই বাচ্চা। কিন্তু তুমি একেবারে পরিণত মানুষের মতো কথা বলো।
নায়ীরা শব্দ করে হেসে বলল, চার দেয়ালের ভেতরে আটকা পড়ে থেকে আমরা বইপত্র পড়া ছাড়া আর কিছু করতে পারি না। আমার বয়সী একটা মেয়ের কী নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি জানি না। সেজন্য আমার কথা হয়তো তোমার কাছে অকালপকের কথার মতো মনে হচ্ছে।
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, না। অকালপক্ব একটি জিনিস আর পরিণত মানুষ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। তুমি অকালপক্কের মতো কথা বলো না, তুমি এই অল্পবয়সেই একেবারে পরিণত একজন মানুষের মতো কথা বলো।
নায়ীরা বলল, তার জন্য আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। যে মানুষটি থেকে আমাদের ক্লোন করা হয়েছে পুরো কৃতিত্ব তার। শুনেছি সে একজন অসাধারণ মহিলা ছিল। আমি যদি তার সম্পর্কে কিছু একটা জানতে পারতাম! আমার এত জানার ইচ্ছে করে।
চেষ্টা করেছ?