টেহলিস শহরে অভিযানের জন্য তাকে নিশ্চয়ই প্রস্তুত করা হবে। নায়ীরা খানিকটা আগ্রহ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। যে মহিলাটিকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার নাম জানা। ক্ৰানা মধ্যবয়স্ক হাসিখুশি মহিলা। নায়ীরার সঙ্গে তার আলাপ-আলোচনা পুরোটাই হল অবমান নিয়ে। বারবার নায়ীরাকে মনে করিয়ে দিল, অবমানব কিন্তু মানুষ নয়। তারা মানুষ থেকে গড়ে ওঠা একটি ভয়ংকর প্রাণী। তাদের ভেতরে স্নেহ-মমতা নেই, ভালবাসা নেই।
নায়ীরা একটু আপত্তি করে বলল, কিন্তু তাদের নিজেদের জন্যও কি স্নেহ-মমতা নেই? একটা পশুও তো তার সন্তানকে বুক আগলে লালন করে?
ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, সেটা ছিল প্রকৃতির নিয়ম। অবমানবরা প্রকৃতিকে অস্বীকার করেছে। তারা নিজেদের মধ্যে বিবর্তন ঘটিয়েছে, সেই বিবর্তনটি তাদের ভয়ংকর একটা। প্রাণী করে তুলেছে।
কী রকম ভয়ংকর?
তারা দেখতেও ভয়ংকর। আমি শুনেছি, একটা বিশেষ প্রজাতির দেহ থেকে দুটি মাথা গড়ে উঠেছে।
নায়ীরা শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করল, দুটি মাথা?
হ্যাঁ। হাতকে আরো কার্যক্ষম করার জন্য সেখানে পাঁচটির বদলে সাতটি করে আঙুল। অনেকের তৃতীয় একটি চোখ রয়েছে।
তৃতীয় চোখ? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, সেটি কোথায়?
কপালের ওপরে। তৃতীয় চোখটি আমাদের চোখের মতো নয়, সেটি সব সময় খোলা থাকে। সেই চোখের পাতি পড়ে না।
নায়ীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী ভয়ংকর!
হ্যাঁ। শারীরিকভাবে ভয়ংকর, কিন্তু সেটা সত্যিকারের ভয় নয়। তারা ভয়ংকর, কারণ তাদের চিন্তাভাবনা ভয়ংকর। মস্তিষ্ককে তারা অন্যভাবে ব্যবহার করতে শিখেছে। কৃত্রিমভাবে নিউরনের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছে। তাদের ভেতরে নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।
নতুন অনুভূতি?
হ্যাঁ, নতুন অনুভূতি, যার কথা আমরা জানি না।
নায়ীরা একটু চিন্তা করে বলল, সেই অনুভূতিগুলো কী ধরনের?
ক্ৰানা গম্ভীর মুখে বলল, আমার মনে হয় না কোনোদিন সেগুলোর কথা আমরা জানতে পারব। যেমন ধর, কষ্ট করে আনন্দ পাওয়া কিংবা যন্ত্রণার ভেতরে সুখের অনুভূতি।
অবমানবদের এ ধরনের অনুভূতি আছে?
হ্যাঁ, আছে। তারা মাঝে মাঝে দল বেঁধে নিজেদের যন্ত্রণা দেয়। তাদের বিকৃত এক ধরনের মানসিকতা রয়েছে।
নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য!
অবমানব সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি নায়ীরাকে সাধারণ কিছু বিষয়ে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া হল–দৈনন্দিন অসুখবিসুখ হলে কী করতে হবে, কী ওষুধপত্র খেতে হবে এই ধরনের গুরুত্বহীন বিষয়। খুব ঠাণ্ডা বা খুব গরম অবস্থায় পড়ে গেলে নিজেকে রক্ষা করার জন্য নায়ীরাকে কিছু বিশেষ পোশাক দেওয়া হল। নারীরা সবচেয়ে আনন্দ পেল এক জোড়া নাইট ভিশন গগলস দেখে, এটি চোখে দিলে অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা যায়। সে ভেবেছিল, তাকে হয়তো আত্মরক্ষার জন্য কোনো একটি অস্ত্রচালনা শেখাবে, কিন্তু বিজ্ঞান কেন্দ্রের সেরকম কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হল না।
রাতে ঘুমানোর সময় নায়ীরা নিজের হাতের ওপর হাত বোলাতে গিয়ে হঠাৎ বাম হাতে একটু সুচ ফোঁটানোর মতো ব্যথা অনুভব করে। তার ডান হাতে বলকারক ওষুধের সিরিঞ্জ লাগানো হয়েছিল কিন্তু বাম হাতে কিছু করা হয় নি। বাম হাতে ছোট লাল বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে থেকে নায়ীরা ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে। নিওরোজিনা দিয়ে যখন তাকে অচেতন করে রেখেছিল তখন এই ছোট লাল বিন্দুটি দিয়ে তার শরীরে কোনো কিছু ঢোকানো হয়েছে। কী হতে পারে সেটি?
তার কাছে সেটি গোপন করে রাখা হচ্ছে কেন?
৪. গাইড মানুষটিকে নায়ীরার খুব পছন্দ হল
গাইড মানুষটিকে নায়ীরার খুব পছন্দ হল। নীল চোখ এলোমেলো চুল এবং রোদেপোড়া তামাটে চেহারা। নায়ীরাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, আমাকে বলেছে একজন মহিলাকে নিয়ে যেতে! তুমি তো মহিলা নও, তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে!
নায়ীরা হেসে বলল, আমাকে বাচ্চা বলা ঠিক হবে না, আমার বয়স পনের।
পনের একটা বয়স হল? আমার বয়স তেতাল্লিশ। তোমার তিন গুণ।
নায়ীরা বলল, আমি আসলে খুব বেশি মানুষ দেখি নি, তাই দেখে মানুষের বয়স অনুমান করতে পারি না। তবে তোমাকে দেখে মোটেও তেতাল্লিশ বছরের মানুষ মনে হচ্ছে না।
কী বলছ তুমি? মানুষের বয়স ঠিক করা উচিত তার অভিজ্ঞতা দিয়ে। যদি সেভাবে ঠিক করা হত তা হলে আমার বয়স হত সাতানব্বই বছর!
সত্যি?
হ্যাঁ। এমন কোনো কাজ নেই যেটা আমি করি নি।
নায়ীরা বলল, তোমার পদ্ধতিতে বয়স ঠিক করা হলে আমি এখনো শিশু। আমার অভিজ্ঞতা বলে কিছু নেই। একেবারে শূন্য।
গাইড মানুষটি বলল, একেবারে শূন্য কেন হবে? নিশ্চয়ই পড়াশোনা করতে স্কুলে গিয়েছ, সেখানে কত রকম বন্ধুবান্ধব, কত রকম শিক্ষক-শিক্ষিকা, কত রকম অভিজ্ঞতা
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, উঁহু, আমি কখনো স্কুলে যাই নি।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, স্কুলে যাও নি?
না। শুধু স্কুল কেন, কোথাও যাই নি। আমার পুরো জীবন কাটিয়েছি চার দেয়ালঘেরা একটুখানি জায়গার ভেতর।
কেন?
নায়ীরা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, কারণ, আমি একজন ক্লোন।
মানুষটি কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, ক্লোন?
হ্যাঁ।
কিন্তু, কিন্তু মানুষটি বিভ্রান্তের মতো বলল, আমাকে তো সেরকম কিছু বলে নি।