সেটাই দেখছি। কিন্তু মেয়ে, তোমাকে বলে রাখি, যখন মনে যেটা আসে সেটা বলার জন্য তুমি বিপদে পড়বে।
ড. ইলাকের কথা শুনে নায়ীরা আবার শব্দ করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক ক্রুদ্ধ চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আবার কেন হাসছ?
তোমরা সবাই মিলে নিশ্চয়ই আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে সরাসরি সেটা বলতে পারছ না তাই নিওরোজিনা, অবচেতন স্মৃতি এসব কঠিন কঠিন কথাবার্তা বলছ! তা হলে তুমিই বলো, সত্যিকার বিপদে পড়ার সুযোগটি আমি কখন পাব?
ড. ইলাক নায়ীরার কথার কোনো উত্তর দিল না, নায়ীরাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে রইল। হঠাৎ করে সে মাথায় একটা মৃদু কম্পন অনুভব করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে বহুদূর থেকে একটা ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটি মধুর এবং বিষণ্ণ। তার বুকের ভেতর কেমন এক ধরনের নিঃসঙ্গতার জন্ম দেয়। শব্দটি শুনতে শুনতে তার চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। কী কারণ জানা নেই, নায়ীরার মনে হতে থাকে ঘুম থেকে জেগে। ওঠার পর তার জীবনটি হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম।
.
নায়ীরার যখন ঘুম ভাঙল তখন সে খুব ক্লান্ত। শুনতে পেল কেউ একজন বলল, চোখ খুলে তাকাও মেয়ে।
নায়ীরার মুখের ওপর একজন নার্স ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার এখন কেমন লাগছে?
নার্সটির মুখে একটা মাস্ক লাগানো, সেই মাস্কটির দিকে তাকিয়ে থেকে নারীরা জিজ্ঞেস করল, তুমি মুখে মাস্ক পরে আছ কেন? আমার কি কোনো অসুখ হয়েছে? আমার শরীরে কি কোনো সংক্রামক জীবাণু আছে?
নার্সটি কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, আমরা যখনই কাউকে দেখতে আসি মুখে মাস্ক পরে থাকি। এটা আমাদের অভ্যাস।
কথাটি সত্যি নয়, কিন্তু নায়ীরা সেটা নিয়ে কথা বলার উৎসাহ খুঁজে পেল না। নার্সটি তার মুখ থেকে মাস্কটি না খুলেই আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার এখন কেমন লাগছে?
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব দুর্বল লাগছে।
নার্সটি বলল, সেটাই স্বাভাবিক।
নায়ীরার জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হল, মস্তিষ্কে স্মৃতি জন্ম দেওয়া হলে শরীর কেন দুর্বল হবে? শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন না করেই সে চোখ বুজে শুয়ে রইল। নার্সটি বলল, আমি তোমার শরীরে একটা বলকারক ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি শক্তি খুঁজে পাবে।
নার্সটি নায়ীরার ডান হাতের শিরায় একটি সুচ ঢুকিয়ে একটা বলকারক তরলের প্যাকেট ঝুলিয়ে দেয়। ফোঁটা ফোঁটা করে সেটা তার শরীরে প্রবেশ করতে থাকে এবং খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের কোমল আরামের অনুভূতি নায়ীরার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
নায়ীরা নিঃশব্দে তার বিছানায় শুয়ে রইল। তাকে ঘিরে লোকজন যাচ্ছে, আসছে, কথা বলছে, যন্ত্রপাতি দিয়ে তাকে পরীক্ষা করছে, কিন্তু কোনো কিছু নিয়েই সে কৌতূহলী হতে পারছে না। কেউ একজন তার হাত স্পর্শ করে তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ড. ইলাক। নায়ীরা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ড. ইলাক বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে মেয়ে?
আমার একটু দুর্বল লাগছে।
সেটা খুবই স্বাভাবিক।
তোমরা কি আমার অবচেতন মনে তথ্যটি প্রবেশ করাতে পেরেছ?
ড. ইলাককে মুহূর্তের জন্য একটু বিব্রত দেখায়, কিন্তু সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে হ্যাঁ, পেরেছি।
আমি কি কোনোভাবে সেই তথ্যটি সচেতনভাবে জানতে পারব?
ড. ইলাক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, পারবে না। কিছুতেই পারবে না।
ড. ইলাক, আমি যতটুকু জানি যে মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত রহস্যময়, বিজ্ঞানীরা কখনো সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। এমন কি হতে পারে না হঠাৎ করে আমি সেটা জেনে গেলাম। স্বপ্নের ভেতরে কিংবা কোনোভাবে সম্মোহিত হয়ে?
ড. ইলাক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, এটা হতে পারে না। নিওরোজিনা দিয়ে তোমার মাথায় তথ্যটি ঢোকানো হয়েছে। শুধু আরেকটি নিওরোজিনা দিয়েই সেই তথ্য বের করা সম্ভব। অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।
নায়ীরা কিছুক্ষণ ড. ইলাকের চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে একটু হেসে আবার চোখ বন্ধ করল। একজন মানুষ যখন মিথ্যে কথা বলে নায়ীরা সেটা বুঝতে পারে। এটি কি তার বিশেষ একটি ক্ষমতা, নাকি সবার জন্যই এটি সত্যি-সে জানে না। জীবনের পুরোটাই সে তার অন্য ক্লোনদের সঙ্গে কাটিয়েছে। মাত্র গত কয়েক দিন হল সে প্রথমবার অপরিচিত মানুষদের দেখছে, তাদের সঙ্গে কথা বলছে। এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সে আবিষ্কার করছে যে, অনেকেই তাকে সত্যি কথা বলছে না। হতে পারে সত্যি কথাটি তার জন্য ভালো নয়, কিন্তু সে তো সত্যিকারের মানুষ নয়, সে একটি তুচ্ছ ক্লোন। তার ভালো মন্দে পৃথিবীর কী আসে যায়? ল্যাবরেটরিতে একটা গিনিপিগকে নিয়ে ভয়ংকর একটা এক্সপেরিমেন্ট করার সময় বিজ্ঞানীরা একটুও ইতস্তত করে না, তার বেলায় কেন করবে? এই প্রশ্নের উত্তরটি কি সে খুঁজে পাবে?
চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরই নায়ীরা তার শক্তি ফিরে পেল। কতটুকু তার নিজের আর কতটুকু নানা ধরনের ওষুধপত্রের ফল, সেটা সে জানে না। সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামাচ্ছে। তাকে টেলিস শহরে একটি দুর্গম অভিযানে পাঠানো হবে। কত তাড়াতাড়ি সেই অভিযানটুকু শুরু করতে পারবে সেটাই এখন তার একমাত্র ধ্যানধারণা। চার দেয়ালে ঘেরা এই বিজ্ঞান কেন্দ্র, বিজ্ঞান কেন্দ্রের কিছু মিথ্যেবাদী মানুষকে তার আর ভালো লাগছে না। তার সঙ্গে একজন গাইড থাকবে। সেই গাইডটি কেমন মানুষ হবে? দীর্ঘ সময় সেই মানুষটির সঙ্গে সে থাকবে, এই মানুষটি যদি একজন খাঁটি মানুষ না হয় তা হলে সেটা কি খুব দুঃখের একটি ব্যাপার হবে না?