নায়ীরা একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমাকে সেজন্য টেহলিস শহরে পাঠাতে চাইছ? একজন মূল্যবান মানুষের জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে মূল্যহীন একজন ক্লোনের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া?
দ্বিতীয় মহিলাটি যে সম্ভবত নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা স্থির চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ইচ্ছে করলে ব্যাপারটাকে এভাবেও দেখতে পার।
নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, টেহলিস শহরে আমাকে কী নিয়ে যেতে হবে?
জিনা বলল, একটি অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য।
সেটি আমি কীভাবে নেব?
তোমার মস্তিষ্কে করে।
নায়ীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আমার মস্তিষ্কে করে?
হ্যাঁ। আমরা তোমার মস্তিষ্কে সেটা প্রবেশ করিয়ে দেব। তুমি সেটা জানবে না।
নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক মুখে হাসি টেনে বলল, আমরা তোমার দেহ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছি। তোমার দেহ নিখুঁত, নীরোগ এবং সুস্থ। তোমার মস্তিষ্ক এই তথ্য নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তুমি তোমার মস্তিষ্কে করে এই তথ্য নিয়ে সুদীর্ঘ যাত্রা শেষ করতে পারবে বলে আমার ধারণা।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে কি একা টেহলিস শহরে যেতে হবে?
কঠিন চেহারার ক্রানা শব্দ করে হেসে ফেলল এবং হাসির কারণে হঠাৎ করে তার মুখের কাঠিন্য সরে যায়। সে হাসি হাসি মুখে বলে, না। তোমার পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব। হবে না। একজন গাইড তোমাকে নিয়ে যাবে।
এই গাইড মানুষটিও কি আমার মতো ক্লোন?
রুবার মুখ থেকে হাসি হঠাৎ সরে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে আগের কাঠিন্যটুকু ফিরে আসে। সে কঠিন মুখে বলে, আমরা তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে যোগ করে, তোমার কি অন্য কোনো প্রশ্ন আছে?
নায়ীরা মাথা নাড়ল, আছে।
কী প্রশ্ন?
আমি সেই প্রশ্নটি করতে চাইছি না।
কেন?
আমার ধারণা, তোমরা সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেবে না।
মহিলাটি কঠিন মুখে বলল, তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ।
নায়ীরা একটু হেসে বলল, তোমরা কেন আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছ?
কয়েক মুহূর্ত ঘরের সবাই চুপ করে থাকে। কঠিন চেহারার রুবা সোজা হয়ে বসে কঠিন গলায় বলল, আমরা তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছি না, মেয়ে।
নায়ীরাও সোজা হয়ে বসে বলল, আমার নাম নায়ীরা।
.
ড. ইলাক নায়ীরার মাথায় গোলাকার একটা হেলমেট বসিয়ে বলল, এটার নাম নিওরোজিনা। এটা তোমার মস্তিষ্কের নিউরনে সিনান্স কানেকশন তৈরি করবে। আমরা যেটাকে স্মৃতি বলি, তোমার মধ্যে সেরকম স্মৃতি তৈরি হবে।
নায়ীরা কোনো কথা না বলে ড. ইলাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক নিওরোজিনা নামের যন্ত্রটির সঙ্গে কয়েকটা তার জুড়ে দিতে দিতে বলল, সাধারণ স্মৃতির সঙ্গে এর একটা পার্থক্য আছে।
কথা শেষ করে ড. ইলাক নায়ীরার দিকে তাকাল। সে আশা করছে নায়ীরা পার্থক্যটুকু জানতে চাইলে সে উত্তর দেবে। নায়ীরা জানতে চাইল না। তার যে জানার কৌতূহল হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু সে ঠিক করেছে, নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করবে না।
ড. ইলাক কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, সাধারণ স্মৃতি আমাদের মনে থাকে। কিন্তু এই স্মৃতি নিওরোজিনা দিয়ে তৈরি কৃত্রিম স্মৃতি, এই স্মৃতি কারো মনে থাকে না।
মুখটা ভাবলেশহীন করে রাখবে ঠিক করার পরও নায়ীরা খুক করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক বলল, কী হল, হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে। মানুষ যদি একটা জিনিস মনে রাখতে না পারে তা হলে সেটা আবার স্মৃতি হয় কেমন করে?
ড. ইলাক মুখে একটা আলগা গাম্ভীর্য এনে বলল, এটাই হচ্ছে নিওরোজিনার বিশেষত্ব। পুরো স্মৃতিটা থাকে অবচেতন মনে। আরেকটি নিওরোজিনা দিয়ে এই স্মৃতিটা বের করে নিয়ে আসা যায়।
প্রশ্ন করার জন্য ভেতরে ভেতরে উসখুস করতে থাকলেও নায়ীরা চুপ করে রইল। পুরো ব্যাপারটিতে নায়ীরার উৎসাহের অভাব দেখে ড. ইলাকও মনে হয় একটু উৎসাহহীন হয়ে পড়ল। একটু দায়সারাভাবে বলল, আমরা এখানে তোমার মস্তিষ্কে একটা গোপন তথ্য দিয়ে দেব, টেহলিস শহরে সেই তথ্যটি বের করে আনা হবে।
নায়ীরা শান্তভাবে ড. ইলাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক একটু ইতস্তত করে বলল, তথ্যটি হবে অত্যন্ত গোপন। অত্যন্ত গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ। এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা তোমার জন্য খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার।
একেবারে ভাবলেশহীনভাবে চুপচাপ বসে থাকবে ঠিক করে রাখার পরেও নায়ীরা আবার খুকখুক করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, তুমি আবার হাসছ। কেন?
তুমি গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পার না।
আমি মিথ্যা কথা বলছি না।
তুমি যদি আসলেই সত্য কথা বলছ, তা হলে বুঝতে হবে মানবসভ্যতার উন্নতি না হয়ে তার বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। আমি যতদূর জানি, প্রায় শখানেক বছর আগেই গোপনীয় খবর নিখুঁতভাবে পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। এই যুগে কেউ যদি কারো মস্তিষ্কে করে অবচেতনভাবে খবর পাঠায়, তা হলে বুঝতে হবে বিজ্ঞান সম্পর্কে তারা বিশেষ কিছু জানে না।
ড. ইলাক শীতল চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বয়সের তুলনায় তোমার কথাবার্তা বেশ অমার্জিত এবং উদ্ধত।
নায়ীরা বলল, আমি দুঃখিত, ড. ইলাক। আমি একটি ক্লোন। নিজের অন্যান্য ক্লোন ছাড়া আর কাউকে দেখি নি, আর কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলি নি। সুন্দর করে, ভদ্রভাবে, মার্জিতভাবে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি সেটা কখনো শিখি নি। যখন মনে যেটা আসে সেটাই বলে ফেলি।